গ্রাম বাংলা ডেস্ক: জয়শ্রী বিয়ে করেছিলেন প্রেম করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে জয়শ্রীর কাছ থেকে দূরে সরে যান তার স্বামী আলিমুল হক টিপু। টিপুর অভিযোগ জয়শ্রীর পরকীয়ার প্রেমের চিঠি ধরা পড়ায় তিনি স্ত্রীকে ঘৃনা করতে শুরু করেন।
ততদিনে সংসারে দুই সন্তান। জীবনে এমন বিপর্যয়ের পরও ভেঙে পড়েননি জয়শ্রী। দ্বিতীয় বিয়েও করেন নি। তার এই জীবন সংগ্রাম দেখে মুনমুন ও মুহাম্মদ বলতো, ‘মা, তুমি এভাবে জীবন কাটাচ্ছো কেন? তুমি বিয়ে করতো পারো। অন্তত একটা প্রেম তো করতে পারো।’ কিন্তু দুই সন্তানই ছিল তার পৃথিবী। এর বাইরে নিজেকে নিয়ে আলাদা কোন স্বপ্ন বুনতে চাননি তিনি। আর্থিক টানাপড়নে দিন কাটছিল।
আত্মহত্যার আগে একটি ইলেকট্রনিক গিটার চেয়েছিল মুহাম্মদ বিন আলিম। বলেছিল, ‘মা, আমি কি একটা গিটার পাবো না? আমি তো তেমন কিছু চাইনি তোমার কাছে।’ কিন্তু তার মা জয়শ্রী জামান তা কিনে দিতে পারেননি। চীন প্রবাসী পিতা আলিমুল হক টিপুর কাছেও একই আবদার করেছিলো মুহাম্মদ। কিন্তু টিপু এক কথায় জবাব দিয়েছেন ‘পারবো না।’ সেই থেকে বিমর্ষ ছিল মুহাম্মদ। খুব কম কথা বলতো। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এ খণ্ডকালীন চাকরি তার মা জয়শ্রীর। স্থায়ী হবে হবে করেও হয়নি। অভাব অনটনে জর্জরীত জয়শ্রীর কষ্ট দেখে মুহাম্মদ ও চিরশ্রী জামান মুনমুন হতাশায় ভুগছিল। গতকাল মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপকালে জয়শ্রী নিজেই জানান এ সব কথা। তিনি জানান, প্রায় এক বছর আগে মুহাম্মদকে একটি গিটার কিনে দিয়েছিলেন জয়শ্রী। এজন্য অনেক কষ্টে বই কম্পোজ করে টাকা সংস্থান করেন তিনি। কিন্তু প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা মূল্যের ইলেকট্রনিক গিটার দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘একটি গিটারের জন্য আমার বাবু চলে গেছে। আমার টাকা নেই বলে আমি আমার সন্তানদের হারিয়েছি। আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো, ওরা কেন এভাবে চলে গেল?’ উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত জয়শ্রীর চিকিৎসা, ছেলে, মেয়ের লেখাপড়ার খরচ, বাসা ভাড়াসহ প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ টাকা ব্যয় হতো। এ নিয়ে হিমশিম খেতেন জয়শ্রী। তার দুই সন্তান তা দৃঢ়ভাবে অনুভব করতো। মুনমুনের তেমন কোন চাহিদা ছিল না। এমনকি নিজের জন্য জামা কিনতে পর্যন্ত আগ্রহ ছিল না তার।
দুই সন্তানকে নিয়ে নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছিলেন জয়শ্রী জামান। স্বপ্ন বুনেছিলেন তার দুই সন্তানকে নিয়ে। তাদের লেখাপড়া করিয়েছেন উত্তরার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। অর্থ সংস্থানের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। পিতাহীন সংসারে দুই সন্তানের তিনিই ছিলেন মা ও বাবা। স্বপ্ন ছিল মেধাবী দুই সন্তান একদিন তার পাশে দাঁড়াবে। মায়ের সকল দুঃখ দূর করে দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। বরং জীবনের সবটুকু সুখ কেড়ে নিয়ে দুই সন্তানই পাড়ি দিয়েছে না ফেরার দেশে। রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গরিবে নেওয়াজ এভিনিউ’র ১১ নম্বর বাড়ির পাঁচতলায় থাকতেন জয়শ্রী। সোমবার রাত আনুমানিক ১১টার দিকে সে বাড়িতে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা। বাসার দুই কক্ষের বারান্দার গ্রিলের সঙ্গে রশি বেঁধে আত্মহত্যা করে সাংবাদিক জয়শ্রীর দুই সন্তান মুনমুন ও মুহাম্মদ। ওই দিন বাদ জোহর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তাদের লাশ। এমন মর্মান্তিক ঘটনায় ভেঙে পড়েছেন দৃঢ় মনোবলের অধিকারিণী জয়শ্রী। সেই থেকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। দিনের বেশির ভাগ সময়ই তাকে অচেতন করে রাখা হচ্ছে ওষুধের মাধ্যমে। নেয়া হয়েছে মোহাম্মদপুরে বোনের বাসায়।
সূত্র জানায়, জয়শ্রী জামানের বাড়ি রাজবাড়ী জেলা সদরের সজ্জনকান্দা। তার পিতা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা একেএম নূরুজ্জামান। চার বোনের মধ্যে জয়শ্রী সবার ছোট। বর্তমানে তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। জয়শ্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একই বিভাগের দুই বছরের সিনিয়র আলিমুল হক টিপুর সঙ্গে প্রেম ও পরে বিয়ে হয় তার। দাম্পত্য জীবনে দু’টি সন্তানের মা-বাবা হন এই দম্পতি। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেই চলছিল তাদের জীবন। কিন্তু তা বেশিদিন সয়নি। বিয়ের ১৪ বছরের মধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাদের। ২০০৮ সালের ৬ই মার্চ জয়শ্রীকে ডিভোর্স দেন আলিমুল হক টিপু। এ সম্পর্কে জয়শ্রী জামান নিজেই একটি খোলা চিঠিতে লিখেছেন, ‘পরকীয়া প্রেমের ব্যাপারে আর আপস করতে না পারায় ছাড়তেই হলো তাকে। তার কাছ থেকে পাওয়া তালাকনামায় ২০০৮ সালের ৬ই মার্চ আমি স্বাক্ষর না দিলেও ১৪ই জুলাই ২০০৮ সালে দিগন্ত টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকা মাহবুবা মুস্তাফা মিলিকে সে বিয়ে করে।’ তখন থেকেই এক করুণ-কঠিন সংগ্রামে নামতে হয় জয়শ্রীকে। প্রথমে চাকরি নেন একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। সেই সঙ্গে টিউশনি করাতেন তিনি। কিন্তু অভাব পিছু ছাড়ছিল না। খুঁজছিলেন অন্য কোন পেশা। খোলা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘অভাব-অনটনের মধ্যেই আমার মেয়ে মুনমুন ‘ও’ লেভেল পরীক্ষা দিয়ে চারটিতে স্টারসহ আটটিতে ‘এ’ পেয়েছে।’ কৃতিত্বের জন্য ডেইলি স্টারের সংবর্ধনা পেয়েছিল মেয়ে মুনমুন। ২০০৮ সালের পর দৈনিক ভোরের কাগজের মাধ্যমে জয়শ্রীর সাংবাদিকতা শুরু। ২০১২ সালে খণ্ডকালীন হিসেবে যোগ দেন বাসসে। গত বছরের ১৬ই জুন তার চাকরি চলে গেলে আবার অভাব-অনটনে পড়েন তিনি। চাকরি ফিরে পেতেই প্রধানমন্ত্রী সমীপে লেখেন খোলা চিঠি। জয়শ্রী নিজেই লিখেছেন চাকরি যাওয়ার আগে সাড়ে তিন মাস বেতন না পেয়ে চরম আর্থিক সমস্যায় পড়েন তিনি। বাধ্য হয়ে চাকরি ফিরে পেতে অনশনে বসেন। এ প্রসঙ্গে জয়শ্রী বলেন, ‘আমার বাচ্চাদের আত্মহত্যার পেছনে আমার চাকরি স্থায়ী না হওয়া একটি প্রধান কারণ। চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় আমার বাচ্চারা অর্থকষ্টে ছিল।’
বাসসের উপ-প্রধান বার্তা সম্পাদক হালিম আজাদ জানান, জয়শ্রীর চাকরি যাওয়ার প্রায় আড়াই মাস পরে জয়শ্রী চাকরি ফিরে পান। এখনও তিনি জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক হিসেবে আছেন। অন্যদিকে তার স্বামী সাংবাদিক আলিমুল হক টিপু দ্বিতীয় বিয়ের পর দিগন্ত টিভি থেকে চাকরি হারান। তারপর নতুন চাকরি নিয়ে তিনি চলে যান চীনে। বর্তমানে তিনি বেইজিংয়ে রেডিও চায়নায় কর্মরত। দ্বিতীয় সংসারে আহমদ বিন আলিম নামে দুই বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। স্বজনরা জানান, আলিমুল ও জয়শ্রীর যখন ডিভোর্স হয় তখন মুহাম্মদের বয়স মাত্র সাত বছর এবং মুনমুনের ১১ বছর। শিশু বয়সে পিতার সান্নিধ্য বঞ্চিত হয় তারা। পিতা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। অন্যদিকে মায়ের আর্থিক টানাপড়েন। এ সবই তাদের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছিল। মা-বাবার বিচ্ছেদ ও মায়ের আর্থিক দৈন্যের কারণেই ধীরে ধীরে হতাশাগ্রস্ত হয় মুনমুন ও মুহাম্মদ। এক পর্যায়ে মাদকাসক্ত হয়ে যায় তারা। ফেসবুকে আলিমুল হক টিপুর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানকে দেখে প্রায়ই মন খারাপ করতেন মুনমুন ও মুহাম্মদ। বিশেষ করে টিপুর ফেসবুক থেকে মুনমুন ও আলিমের ছবি মুছে ফেলায় মুনমুন ও আলিম খুব আঘাত পান বলে স্বজনরা জানান। জয়শ্রী জানান, মাস শেষে দুই সন্তানের কোচিং ও স্কুলের বেতন বাবদ দিতো হতো ২২ হাজার টাকা। ঘর ভাড়া দিতে হতো ২০ হাজার টাকা। তাছাড়া অন্যান্য ব্যয়তো ছিলোই। সন্তানদের জন্য মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা পাঠাতেন টিপু। তবে সর্বশেষ তিনি ২৭ হাজার টাকা দিয়েছেন বলে জানান জয়শ্রী। কিন্তু সন্তানদের সঙ্গে ফোনে খুব কম কথা বলতেন টিপু।
সাধারণত সকাল ১১টায় বাসা থেকে বের হতেন জয়শ্রী। ফিরতেন রাত ১১টার পরে। স্কুলের নির্ধারিত সময়ের পর বাসায় একা থাকতো তার দুই সন্তান মুহাম্মদ ও মুনমুন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বেলমন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র মুহাম্মদ নিজেই গাঁজা ও ইয়াবা সংগ্রহ করতো। যদিও তাদের মা জয়শ্রী সন্তানদের মাদক নেয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন তারা ধুমপান করতো। ঘটনার দিন সোমবার বাইরে কোথাও যায়নি তারা। তবে দুপুরে একবার বাসার সামনের দোকানে গিয়ে মার্লবোরো সিগারেট কিনেছিল মুনমুন। ফাঁকা বাসায় সিগারেটের মধ্যে গাঁজা ভরে সেবন করতো তারা। মাদক ও পারিবারিক কারণেই দুই কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার পথে ধাবিত হয়েছে বলে নিহতদের স্বজন ও পুলিশের ধারণা। উত্তরা পশ্চিম থানার সাব ইন্সপেক্টর হারুন-অর-রশিদ জানান, গাঁজা, ইয়াবা, সিগারেটসহ নানা ধরনের মাদকে আসক্ত ছিল আলিম ও মুনমুন। তবে মাদকের বিষয়টি সত্য না বলে দাবি করেন জয়শ্রী। তিনি বলেন, আমর সন্তানরা ধুমপান করতো। কিন্তু মাদক সেবন করতো না। দুই সন্তানকে হারিয়ে জয়শ্রী এখন দুঃখভারাক্রান্ত। আত্মীয়-স্বজনসহ তার সহকর্মীদের মুখে একটি প্রশ্ন- স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স এবং দুই সন্তানের মৃত্যুর পর কি নিয়ে বাঁচবেন জয়শ্রী?