১৬ কোটি মানুষ পালিয়ে যাব?

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি
c18c58d0ed92842b70b1a880309a1b6a-4
বাংলাদেশের অর্ধেকটা সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবে ৪০ বছরের মধ্যে। কোটি কোটি মানুষ হবে উদ্বাস্তু।
বাংলাদেশে ভূমিকম্প হবে ৯ মাত্রার। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রা হলো ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ পর্যায়। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই বাংলাদেশের অধিকাংশ ভবন ভেঙে যাবে। ৮ মাত্রার হলে বাংলাদেশে কোনো ভবনের টিকে থাকার কোনো কারণ নেই। আর ৮-এর চেয়ে বেশি? যেখানে এই মাত্রার ভূমিকম্প হবে, সেখানে মহা প্রলয় ঘটে যাবে, রাস্তাঘাট পর্যন্ত ঠিক থাকবে না, রাজপথ হয়ে যাবে নদী, নদী হয়ে যেতে পারে পাহাড়।
কোথাও কোনো আশা নেই।
এর মধ্যে আছে জঙ্গি হামলা। ঈদের দিন বাংলাদেশে ঈদের জামাতে কেউ হামলা করতে পারে, কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল? রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়বে সশস্ত্র জঙ্গিরা, আর একে একে কুপিয়ে হত্যা করবে মানুষদের, আমাদের বিদেশি অতিথিদের, এ রকম বাংলাদেশের কথা ১০ বছর আগেও কেউ ভাবতে পারত? দুই বছর আগেও?
এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন, জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা ও নাগরিকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, একই সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় একযোগে হামলা হতে পারে।
মানুষের সামনে কোনো আশা নেই, কোনো আশ্বাস নেই, কোনো বরাভয় নেই। আছে শুধু কথার ফুলঝুরি।
বলা হচ্ছে, জঙ্গি হামলার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা থামিয়ে দেওয়া! হ্যাঁ। এভাবে যদি বিদেশিদের নিশানা করে খুন করা হয়, তাহলে বিদেশিরা এই দেশে আসতে চাইবেন না। হলি আর্টিজানে নিহত জাপানিরা এসেছিলেন এই দেশে জাইকার হয়ে, মেট্রোরেল বানানোর কাজে যুক্ত ছিলেন তাঁরা। ইতালীয়রা এসেছিলেন ব্যবসায়িক কাজে। যদি আমাদের দেশে বিদেশি ক্রেতারা না আসতে পারেন, বিদেশি উন্নয়ন–সহযোগীরা না আসতে পারেন, এই দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, থেমে যাবে উন্নয়নের চাকা। হিসাবটা খুবই সহজ।
বিরোধী দল এই দাবি করছে, জঙ্গি হামলা সামলাতে সরকার ব্যর্থ, এই ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে সরকারের উচিত গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচন দেওয়া। বিরোধী দলের তো এই রকমই বলার কথা। আর এটাকে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা হবে, এই দেশে তাও কি খুব বিস্ময়কর কিছু!
আর সবকিছু করছে বিএনপি-জামায়াত, দেশে কোনো আইএস নেই—সরকার এ কথা বলে বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদেরই দলে দলে গ্রেপ্তার করছে, জঙ্গি হামলাকে তারা নিচ্ছে বিরোধী দল ও মতকে দমন করার এক মোক্ষম সুযোগ হিসেবে, বিরোধী দলের এই অভিযোগও আমাদের বিস্মিত করে না।
এই হামলার সঙ্গে আইএসের কোনো সম্পর্ক নেই—বারবার দাবি করা হচ্ছে। এই জঙ্গিরা হোমগ্রোন, এই দেশেই এরা জন্ম নিয়েছে। আবার বলা হচ্ছে, যে বিদেশি শক্তি এই জঙ্গিদের মদদদাতা, দায়দায়িত্ব তাদেরই বহন করতে হবে। করতে হবে—এটা আমরাও বলব। যেকোনো বিবেকবান মানুষই বলবেন, যদি এর পেছনে বিদেশি শক্তি থাকে, তাহলে তারাই দায়ী, দায়িত্বও তাদের। বলবেন বটে, কিন্তু সেই দায় নিতে তাদের বাধ্য করবে কে? ইরাকে হামলা করা হয়েছিল ভুল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে, প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যকে বাড়িয়ে বলে, আজকে তা বলা হচ্ছে, কিন্তু যে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে, তাদের জীবন আর ফিরিয়ে আনা যাবে কি?
আমরা ভূমিকম্পে মারা যাব, আমরা জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ডুবে মরব। আমরা মারা যাব জঙ্গি হামলায়, নয়তো জঙ্গি হামলার ফলে আমাদের যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, তার প্রতিক্রিয়ায় ভুগে ভুগে। যে ছেলেরা হারিয়ে গেছে বাড়ি থেকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে, তাদের খুঁজে বের করে তাদের নিবৃত্ত, নিরোধ করতে পারলে হয়তো আপাতত শান্তি আসবে। কিন্তু নতুন রিক্রুট কি বন্ধ হয়ে যাবে?
এটা নির্ভর করছে অনেকগুলো শর্তের ওপরে। একটা হলো, আইএস কত দিন টিকে থাকবে। প্রথম আলোয় ১০ জুলাই জেফরি ডি স্যাক্স নামের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপকের একটা লেখা ছাপা হয়েছে। শিরোনাম ‘আইএস কেন টিকে আছে’। তাতে তিনি যা বলছেন, তার অর্থ দাঁড়ায়, সিরিয়ায় বাশারকে সরাতে চায় আমেরিকা, সৌদি আরব, ইসরায়েল আর তুরস্ক। আর বাশারের পক্ষ হয়ে আইএসের বিরুদ্ধে লড়ছে রাশিয়া আর ইরান। আইএস টিকে আছে আসলে আমেরিকা, সৌদি আরব, ইসরায়েল আর তুরস্কের কারণে। এটা তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের ব্যাপার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি হচ্ছে না, তাদের কীই-বা যায়-আসে! ফলে যত দিন আমেরিকা আইএসের উৎখাত চাইবে না, তত দিন আইএস টিকে থাকবে। কিন্তু আমেরিকা যদি আইএসের উৎখাত চায়ও, তাহলেই কি আইএস ধ্বংস হয়ে যাবে? ফ্রাংকেনস্টাইনের দৈত্য তৈরি হয়ে গেলে তা পরে ফ্রাংকেনস্টাইনকেই মারতে আসে। আর আইএস যদি তার ভূখণ্ড হারিয়ে ফেলে, এই জঙ্গিরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতদের সরাতে যে তালেবানদের একদা সাহায্য করেছিল আমেরিকা, তারাই শেষে আল-কায়েদার হয়ে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছে।
বাংলাদেশ থেকে আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া গেছে এ দেশের নাগরিকেরা, এটা আর কোনো নতুন খবর নয়। আবার কানাডা থেকে, যুক্তরাজ্য থেকে, অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা গেছে, নারী-পুরুষ মায় শিশু পর্যন্ত, এই সব খবরও আমরা পড়েছি। কাজেই বাংলাদেশ খুব শিগগির এই বিপদ থেকে মুক্ত হবে, সে আশাও করা যাচ্ছে না। তাহলে কী হবে? আমরা আশা হারিয়ে ফেলব? ১৬ কোটি মানুষ পালিয়ে যাব, দেশান্তরি হব?
ভূমিকম্প বিষয়ে বলতে পারি, ৯ মাত্রার ভূমিকম্প যদি পৃথিবীর কোথাও হয়, সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ হবে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের মতো। কিছুই করার নেই। ভূমিকম্প হবেই, হলে কবে হবে, সেটা কত মাত্রার হবে—এটা কেউ বলতে পারে না। আমাদের দেশে গত এক হাজার বছরে এত বড় ভূমিকম্প হলে মহাস্থানগড়ের ওই স্তূপও টিকে থাকত না। তিন শ বছরের মধ্যে হলে মোগল আমলে বানানো ভবনগুলো ধ্বংস হয়ে যেত। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়েছে ১৯১৫ সালে, ১০০ বছরে ভাঙেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল আমরা ভোগ করছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াও আমরা শিখে ফেলছি। বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকা কেবল নয়, জয়লাভ করার একটা অপরূপ ক্ষমতা ও যোগ্যতা বাংলাদেশের মানুষের আছে।
জঙ্গি–বিষয়ক এই বিপদের মধ্যে সরকারের করণীয় আছে অনেক। করণীয় আছে প্রত্যেক নাগরিকের, প্রতিটা পরিবারের, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আর প্রতিষ্ঠানের, গণমাধ্যমের ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। সার্বিকভাবে সমাজে ভিন্নমত, ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন রং, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের সম্মান করা, শ্রদ্ধা করার প্রবণতা কম। এটা যেমন তথাকথিত প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে, তেমনি প্রগতিশীলদের মধ্যেও সমানভাবে দেখা যায়। আমার মতই শ্রেষ্ঠ, কাজেই অন্য সব মত নির্মূল করে আমার মতটাকেই কায়েম করতে হবে, এই চিন্তা বিপজ্জনক। তার কুফল আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আর দরকার গণতান্ত্রিক পরিসর। আমার মনে যদি কোনো ক্ষোভ থাকে, আপত্তি থাকে, তা যেন আমি নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রকাশ করতে পারি। রাজনীতিতেও বিভিন্ন মত নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রকাশের সুযোগ থাকতে হবে। চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির, সেই স্বপ্নের পরিবেশ অনেকাংশেই চরমপন্থাকে নিরুৎসাহিত করে।
আশাব্যঞ্জক দুটো লেখার কথা বলে এই রচনা শেষ করব। একটা প্রকাশিত হয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস-এ, ১০ জুলাই। তাতে গুলশান হলি আর্টিজানের বাইরে ফুলের তোড়া আর শ্রদ্ধার্ঘ্য সমাহারে একটা বাংলাদেশি কিশোরীর লেখা বাণী ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছে। ‘ডিয়ার ফরেনারস, উই স্টিল হ্যাভ মেনি ফারাজ ভাইয়াস, সো ডোন্ট লুজ ফেইথ ইন আওয়ার কান্ট্রি।’ প্রিয় বিদেশিগণ, আমাদের এখনো অনেক ফারাজ ভাইয়া আছে, সুতরাং তোমরা আমাদের দেশের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ো না। বাংলাদেশ নামের দেশটা তো তৈরি হয়েছে একটা স্বপ্ন থেকে, একটা প্রতিবাদ থেকে, যে আমরা বাঙালি, আমরা পাঞ্জাবি নই। আমাদের আছে নিজেদের ভাষা, নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের সাহিত্য, নিজেদের বেশভূষা, খাদ্য। আমরা শান্তিপ্রিয়। আমরা পাশাপাশি মিলেমিশে থাকতে জানি। আমাদের সেই আত্মাটাকে কি বোমা মেরে, গুলি করে, কুপিয়ে মেরে ফেলা যাবে?
দ্বিতীয় লেখাটা প্রকাশিত হয়েছে স্ক্রল. ইন নামের একটা অনলাইন পত্রিকায়। ব্রাড ওয়ং নামের একজন অস্ট্রেলীয় অর্থনীতিবিদ লিখেছেন (১০ জুলাই) ‘ঢাকা ইজ ক্রেজি অ্যান্ড বিউটিফুল। ইট শুড নট কাউডাউন টু দ্য মাইন্ডলেস টেরর। (ঢাকা পাগলাপারা আর সুন্দর, তার উচিত নয় বিবেকহীন সন্ত্রাসের কাছে নত হওয়া।’ লেখক এক বছরে চারবার এসেছেন বাংলাদেশে, হলি আর্টিজানে খেয়েছেন, বনানী লেক পার হয়েছেন নৌকায়, আজানের ধ্বনি শুনে মুগ্ধ হয়েছেন, আবার পুরান ঢাকায় গেছেন হোলি উৎসবে যোগ দিতে। তিনি বলেছেন, ঢাকা সুন্দর। কারণ এর মানুষেরা উদার, মুক্তমনা ও বড় হৃদয়।
বাংলাদেশের গুলশান হামলায় বিশ্বনাগরিকদের প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত? বাংলাদেশের মানুষদের প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত। তিনি বলছেন, ব্যক্তি হিসেবে হয়তো একজন মানুষের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বেশি কিছু করার নেই, কিন্তু একটা কাজ পৃথিবীর যেকোনো নাগরিকই করতে পারে। সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্য হলো মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়া। ব্রাড ওয়ং বলছেন, ব্যক্তি হিসেবে আমাদের করণীয় হলো, ভয় না পাওয়া, ভয়কে জয় করা। তিনি বলছেন, সন্ত্রাসে পৃথিবীর কোনো নাগরিকের মরার চেয়ে নিজের ভুলের কারণে মরার সম্ভাবনা (প্রবাবিলিটি) ৬০০ গুণ বেশি।
গুলশান হামলার পর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশ নিয়ে যেসব লেখা ছাপা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষের অতিথিপরায়ণতার কথাও উঠে আসছে। এই দেশের মানুষ যে সাম্প্রদায়িক নয়, মৌলবাদী নয়, তা বলা হচ্ছে। আমাদের বিজয়ের বীজ লুকিয়ে রয়েছে সেই জায়গাটাতে। আমাদের নেতৃত্ব খুব বেশি ভুল না করলে এই বিপদ আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব, নিশ্চয়ই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *