দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই তদন্তে

Slider জাতীয়

 

untitled-7_217086

 

 

 

 

 

চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর খুনিরা ছিল পেশাদার। এ ছাড়া এই ধরনের টার্গেট কিলিংয়ের জন্য খুনিরা উচ্চ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এদিকে তদন্তকারীদের সন্দেহের তালিকায় জঙ্গি-শিবিরের পর এবার যোগ হয়েছে স্বর্ণ চোরাচালানিরা। সব দিক বিবেচনায় রেখে চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত চললেও গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার। মিতু খুনের ঘটনা অনুসন্ধানে চট্টগ্রামে এসেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিইউ) একটি প্রতিনিধি দল। হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, ‘তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হলেও কিছু তথ্য ও বস্তুগত অগ্রগতি আছে। আজ বুধবারের মধ্যে আমরা ভালো কিছু জানাতে পারব।’ খুনিদের গ্রেফতারের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমরা সব দিক পর্যবেক্ষণ করেই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছি। মূল জায়গায় আঘাত হানতে একটু সময় নেওয়া হচ্ছে। নিশ্চিত হয়েই খুনিদের

গ্রেফতারে অভিযান চালাব।’

এদিকে উদ্ধার হওয়া মোটরসাইকেলের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে গতকাল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতারের পর সিএমপির গোয়েন্দাদের কাছে হন্তান্তর করেছে বলে জানান সিএমপি কমিশনার। জিজ্ঞাসাবাদে দেলোয়ার জানিয়েছেন, তার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কধুরখীল উপজেলায়। থাকেন নগরীর জামালখানে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগে তিনি মোটরসাইকেলটি বিক্রি করে দিয়েছেন। এরপর হাত ঘুরে মোটরসাইকেলটি এখন কার কাছে আছে তিনি জানেন না।

গতকাল রাতে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুনের কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি চুরি হয়েছিল। দেলোয়ার হোসেন বেশ কয়েক বছর আগে বোয়ালখালীর গোমদণ্ডি এলাকার বাবুর্চি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে মোটরসাইকেলটি বিক্রি করেন। ৯ মে মোটরসাইকেলটি ওই বাবুর্চির বাড়ি থেকে চুরি হয়। এ ঘটনায় বোয়ালখালী থানায় একটি জিডিও করা হয়। জিডির কপিটি সমকালের কাছে সংরক্ষণে আছে। নগর পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহারের জন্যই মোটরসাইকেলটি চুরি করেছিল খুনিরা।

গতকাল বিকেল ৪টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মিতু হত্যার প্রতিবাদে সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকদের অংশগ্রহণে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। জঙ্গিদের আতঙ্ক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের পরিবারের ওপর এ ধরনের হামলার নিন্দা জানিয়ে মিতুর খুনিদের গ্রেফতারের দাবি জানান তারা। মানববন্ধনে সাংস্কৃতিক সংগঠক ডা. চন্দন দাশ বলেন, ‘বাবুল আক্তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে জীবনবাজি রেখে একের পর এক সফল অপারেশন করেছেন। এরই পরিণতি হিসেবে তার স্ত্রী টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন। আমরা রাজপথে মানববন্ধন করব সৎ-সাহসী পুলিশ অফিসারদের মনোবল অটুট রাখতে।’

খুনিরা ছিল প্রশিক্ষিত :মিতুর খুনিরা এই ঘটনার আগেও এ রকম খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে মনে করছেন চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার। সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়া খুনিদের চলাফেরা, অঙ্গভঙ্গি, পালানোর ধরন, হামলার প্রকৃতিসহ সামগ্রিক বিষয়েই খুনিরা খুবই দক্ষ বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘পূর্বপরিকল্পনা করেই প্রযুক্তিগত সব নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলো থেকে নিজেদের বাঁচিয়েই তারা এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে।’ এ ছাড়া খুনিরা এই কাজের জন্য আগে থেকেই প্রচুর হোমওয়ার্ক করেছে বলে উঠে এসেছে তদন্তে। খুনের সময় তারা এমন একটি স্পট বেছে নেয়, যেখানে চারদিক থেকে কোনো সিসি ক্যামেরাতেই স্পষ্ট ফুটেজ নেওয়া সম্ভব নয়। পালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা প্রধান সড়কের বদলে উপসড়কই বেছে নিয়েছে। কারণ খুব সকালে এসব সড়কে ট্রাফিকও থাকে না। খুনিদের এ ধরনের কৌশল নগরীর চকবাজারে নার্সিং কলেজের শিক্ষক অঞ্জলী হত্যার কৌশলের সঙ্গে অনেকটাই মিল পাচ্ছেন গোয়েন্দারা।

বন্দরনগরীতে সিটিইউ টিম :চট্টগ্রামে আসা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিইউ) তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে রয়েছেন ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম। অপর দুই সদস্য হলেন_ অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল মান্নান ও একজন সহকারী কমিশনার। ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, এ হত্যাকাণ্ডে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার আলামত পাওয়া গেছে। জঙ্গি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য আমাদের কাছে আছে। প্রাপ্ত আলামতের সঙ্গে আমাদের তথ্যগুলো মিলিয়ে দেখা হবে। তথ্যের আদান-প্রদান ও সমন্বয় করে কাজ করা হবে। সকালে চট্টগ্রামে এসে সিএমপি কার্যালয়ে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন সিটিইউর তিন কর্মকর্তা।

অন্ধকারে পুলিশ :৭২ ঘণ্টা পার হলেও মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনও অন্ধকারে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডটি কোনো জঙ্গি সংগঠন বা জামায়াত-শিবির করেছে নাকি অন্য কোনো সংক্ষুব্ধ পক্ষ পেশাদার খুনি ভাড়া করে ঘটিয়েছে তা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না পুলিশ। কখনও মোবাইলের এসএমএস, কখনও কালো রঙের মাইক্রোবাস, কখনও বাবুল আক্তারের স্ত্রীর আগেভাগে বাসা থেকে বের হওয়া ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে মামলার তদন্ত সংস্থা সিএমপির গোয়েন্দা ?পুলিশ। শুরুতে চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিলেও সম্পৃক্ততা না পেয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে সিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমরা এখনও মূল জায়গায় পেঁৗছাতে পারিনি, এটাই বাস্তবতা।’

মোটরসাইকেলের পর কালো রঙের মাইক্রোবাস :সিএমপি কমিশনার বলেন, ‘খুনিদের মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা কালো রঙের মাইক্রোবাসটির গতিবিধি দেখে আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছি, এটা খুনিদের ব্যাকআপ ফোর্স হিসেবে কাজ করছিল। আমরা মাইক্রোবাসটি জব্দ করার চেষ্টা করছি।’ শহরের বিভিন্ন অংশ থেকে পুলিশ আরও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে জানিয়ে ইকবাল বাহার বলেন, ‘আশা করি, খুনিদের স্পষ্ট ছবিও পেয়ে যাব।’

সন্দেহে স্বর্ণ চোরাচালানিরাও :চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি রাতে রিয়াজউদ্দিন বাজারে বাহার মার্কেটের ছয়তলার দুটি কক্ষ থেকে তিনটি লোহার সিন্দুক জব্দ করে সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ। এর মধ্যে একটি সিন্দুকে আড়াইশ’ স্বর্ণের বার এবং আরেকটিতে নগদ ৬০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। ওই স্বর্ণ উদ্ধারের মধ্য দিয়ে একটি চোরাচালানি সিন্ডিকেটের তথ্য পান তৎকালীন গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার বাবুল আক্তার। পদোন্নতি পেয়ে বদলির আগে তিনি ওই সিন্ডিকেটের সদস্যদের গ্রেফতারে কার্যক্রমও শুরু করেছিলেন। গোয়েন্দারা জানান, মাহমুদা খানম মিতুর খুনের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী দায় স্বীকার করেনি। আবার সাধারণত জঙ্গিরা নিরীহ নারী-শিশুদের ওপর আঘাত করে না। চোরাচালানি মাফিয়াদের হাত অনেক লম্বা। তারা বাবুল আক্তারের ওপর সংক্ষুব্ধ ছিল। তাই ওই চক্রটি ভাড়াটিয়া খুনি দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে কি-না তাও তদন্ত করা হচ্ছে।

সিএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, ‘জঙ্গি-জামায়াত-শিবির সম্পৃক্ততার বাইরে আরও যে যে অপশন আছে, সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *