জঙ্গি অর্থায়নে ৯ ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠান

Slider জাতীয়
44_215729
দেশে-বিদেশে জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগে ৮টি ব্যাংকের ৩৭টি অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এর মধ্যে ৩০টি জব্দ করা হয়। এসব অ্যাকাউন্টের স্বত্বাধিকারী ৯ ব্যক্তি। এ ছাড়া ব্যবসার আড়ালে জঙ্গি অর্থায়ন করছে_ এমন পাঁচটি প্রতিষ্ঠানও চিহ্নিত করা হয়েছে। জঙ্গি অর্থায়নে চিহ্নিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই একই পরিবারের সদস্য বা তাদের মাধ্যমে স্বার্থসংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। গত ১৯ মে ১২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের অনুলিপি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে এ ঘটনায় স্পেনে পলাতক সন্দেহভাজন একজনকে আইনের আওতায় আনতে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশের ইন্টারপোলের প্রতিনিধিকে চিঠি দিয়েছে পুলিশ। অভিযুক্ত অন্তত চারজনের ঠিকানায় যোগাযোগ ও টেলিফোন করে তাদের পাওয়া যায়নি।

সম্প্রতি দেশে একের পর এক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু ঘটনায় জড়িতরা গ্রেফতার হলেও অর্থায়ন ও মদদদাতারা চিহ্নিত হন না_ এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। একসঙ্গে জঙ্গি অর্থায়নের ঘটনায় এত সংখ্যক হিসাব নম্বর ও

প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে শিগগিরই জড়িতদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিবির ডিসি (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ  বলেন, কলার চালানের আড়ালে জঙ্গিরা মোটা অঙ্কের অর্থ স্থানান্তর করছিল। হুন্ডি ও মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিদেশ থেকে জঙ্গি অর্থায়নের টাকা আনা হয়। এর সঙ্গে জড়িত মানি এক্সচেঞ্জকে শনাক্ত করা হয়েছে। পুরো ঘটনার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

সিনিয়র সহকারী কমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী  বলেন, গত বছরের শেষ দিকে বিশেষ কোড ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের টাকা দেশের বাইরে যাচ্ছে_ এমন তথ্য পাওয়া যায়। হাতেনাতে কারওয়ানবাজার থেকে ৩৮ লাখ টাকাসহ আবুল হাসনাত নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গিদের অর্থায়নের ব্যাপারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী ও অর্থ পাচার আইনে দায়ের করা মামলার তদন্ত চলছে। পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আর্থিক নেটওয়ার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, জঙ্গি তৎপরতায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অর্থ লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য এতে তুলে ধরা হয়েছে। যেসব ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে তারা হলেন_ আবুল হাসনাত, পেশা ব্যবসায়ী। ঠিকানা_ মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি। হাসনাতের ন্যাশনাল আইডি কার্ড নম্বর_ ৪৭৯৮৫১৭২৩০৬১৭। এ তালিকায় আছেন রাজশাহীর গোদাগারীর বাসুদেবপুরের নাহিদউদ্দোজা মিয়া, হাসনাতের ছেলে সাইফুল হক সুজন, আতাউল হক, খুলনার মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, নওরীন ইসলাম, আঞ্জুমানারা, মমতাজ বেগম ও সেলিনা রহমান। আবুল হাসনাতের বিভিন্ন ব্যাংকে ছয়টি হিসাব নম্বর রয়েছে। তার ছেলে আতাউল হকের পাঁচটি, হাসনাতের ঘনিষ্ঠ নাহিদউদ্দোজার সাতটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে।

যেসব প্রতিষ্ঠানকে জঙ্গি অর্থায়নের জন্য সন্দেহ করা হচ্ছে সেগুলো হলো_ আইটিএস সলিউশন লিমিটেড। এর স্বত্বাধিকারী হলেন_ মো. নাহিদউদ্দোজা, ওয়াকিলুর ইসলাম ও কে এম আরমান ইমতিয়াজ। তাদের কার্যালয়ের ঠিকানা ১৬ পুরানা পল্টন গ্গ্নোরিয়ানা ভবন। আরও চারটি প্রতিষ্ঠান হলো_ এভাতার টেকনোলজিস, আলিফ বায়োফুয়েল, আইব্যাকসটেল ইলেকট্রনিক্স ও আইব্যাকস লিমিটেড। এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আবুল হাসনাত ও তার স্বজনরা সম্পৃক্ত। আলিফ বায়োফুলের নামে ৬০ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়। যা শেষ পর্যন্ত আটকে দেওয়া গেছে।

যেসব হিসাব নম্বর জব্দ করা হয়েছে সেগুলো হলো_ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের তাজুল ইসলামের কারওয়ানবাজার শাখার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর- ০১১৬-১২২-০০০৭৪৫১৯। একই ব্যক্তির মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ০০১৪-০৩১০০৬৯০৯৭ হিসাব নম্বরটিও জব্দ করা হয়। এই হিসাব নম্বরে ২০১৫ সালের ৮ জুন থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা জমা হয়েছে। যার মধ্যে ২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। হিসাব নম্বরে জমা করার অর্থের মধ্যে ৫৯ লাখ টাকা নগদ ও বাকি অর্থ বেতন-ভাতাদি বাবদ ট্রান্সফারের মাধ্যমে জমা হয়। নাহিদউদ্দোজার ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ১১৭১০১০১৭০৭৯১ হিসাব নম্বর জব্দ করা হয়েছে। এই হিসাব নম্বরে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৮ লাখ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। আইব্যাকস টেল ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড নামে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে আরও দুটি হিসাব নম্বর খোলা হয়। যাতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেমিটেন্সের মাধ্যমে ৬০ দশমিক ১৮ লাখ টাকা জমা হয়। হিসাবটিতে নগদ অর্থে জমা দেন নাহিদউদ্দোজা ও সিলেটের জনৈক জামিল আহমেদ চৌধুরী। ওই হিসাব থেকে বিভিন্ন সময় আবুল হাসনাত টাকা তুলেছেন। এ ছাড়া টাকা তুলেছেন আতাউল হক, জাহাঙ্গীর, মশিউর রহমান, আনিসুর রহমান, মামুনুর রশিদ, মাহাবুবুল হক, কালাম, মুন্না, হোসেন আহমেদ, মিঠু, মাহি, মো. আলী, আবু হানিফ, অজিত বুব, মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তবে ওই টাকা তারা কোথায় ব্যবহার করেছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ইইএফ ইউনিট থেকে জানা যায়_ আইব্যাকসকে ইইএফ থেকে ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা মঞ্জুর করা হয়। এ ছাড়া প্রতিবেদনে আবুল হাসনাতকে ইউরো-বাংলা এগ্রো ফিশারিজকে চেয়ারম্যান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকে তার ২০৫০৩১৬০২০০৫৭৯৮০৮ হিসাব নম্বরে ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ লাখ ৭ হাজার টাকা জমা হয়। সমপরিমাণ অর্থ তিনি উত্তোলন করেন। এ ছাড়া আবুল হাসনাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বরে ২০১১ সালের ২২ মে থেকে ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত এক কোটি এক লাখ ২০ হাজার টাকা জমা হয়। তার মধ্যে ৮২ লাখ ৪৯ হাজার টাকা তুলেছেন তিনি।

জানা গেছে, আইব্যাকস লিমিটেডের একটি হিসাব নম্বরে বিদেশ থেকে ৮৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা আসে। যা বর্তমানে ওই হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়।

ডিবির একটি সূত্র জানায়, এক সময় আবুল হাসনাতের দুই ছেলে সাইফুল হক সুজন ও আতাউল হক সবুজ যুক্তরাজ্যে থাকতেন। সেখানে থাকার সময় তারা উগ্রপন্থি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। এরপর ২০১১ সালের পর তারা দেশে ফেরেন। বর্তমানে সবুজ স্পেনে রয়েছেন। বিশ্বের কয়েকটি দেশে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের নামে জঙ্গি অর্থায়ন সংগ্রহ করছেন বলে সবুজের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে তার বাবা ও দুই ভাইসহ কয়েকজন পুলিশের তদন্তের আওতায় রয়েছেন। তাদের বিভিন্ন সময় হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সাইফুল হক সুজন বিদেশে জঙ্গি তৎপরতায় নিহত হন বলে তথ্য আছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গি অর্থায়নে অনেক গ্রুপ জড়িত। তাদের শেকড় গভীরে। টিএফআইতে বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে উগ্রপন্থিদের অর্থায়নের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার হাফেজ সালাহুল ইসলামকে বিভিন্ন দফায় টিএফআইতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখানে তিনি জানান, কক্সবাজারে মাদ্রাসার নামে অনুদানের কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে অর্থ আনা হয়। ওই অর্থের কিছু উগ্রপন্থিদের হাতে গেছে। শুধু নিজেদের মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা, ব্যাংক ডাকাতি, ছিনতাই নয়; জঙ্গিরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে দেশে-বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করছে। অনেক ক্ষেত্রে উগ্রপন্থিদের অপারেশনের অর্থ ব্যয় ছাড়াও পরিবারের অনেক সদস্যকে মাসিক ভিত্তিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে চাঁদা দেওয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *