৪ চুক্তি, সন্ত্রাসবাদ দমনে ঐকমত্য

Slider সারাবিশ্ব

 

 

12658_f2

 

 

 

 

 

চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা এবং উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ ও কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী। দুই নেতার নেতৃত্বে গতকাল অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছে চারটি সহযোগিতামূলক চুক্তি। ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী শেখ জাবের আল মুবারাক আল সাবাহ। গতকাল বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবাহর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পরে চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়। দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর আগে দুই সরকার প্রধানের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক জানান, চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ দমনে দুই দেশের মতৈক্য রয়েছে। এ বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করতে দুই প্রধানমন্ত্রী ঐকমত্য হয়েছেন।
স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা চুক্তি। কুয়েতের শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ড. বদর আহমদ আল ইসা এবং বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ‘দি এগ্রিমেন্ট ফর দি প্রমোশন অ্যান্ড রিসিপ্রোকাল প্রটেকশন অব ইনভেস্টমেন্ট’ শীর্ষক এ চুক্তিতে সই করেন। পরে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় বাংলাদেশে বিনিয়োগের একটি নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। পরে কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের ভিসা সহজীকরণ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কুয়েতের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রদূত খালেদ সুলায়মান আল জারাল্লাহ এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ‘দি এগ্রিমেন্ট অন মিউচুয়্যাল এক্সেমপশন অব প্রাইয়র এন্ট্রি ভিসা ফর হোল্ডারস অব ডিপ্লোম্যাটিক, স্পেশাল অ্যান্ড অফিসিয়াল পাসপোর্ট’ শীর্ষক চুক্তি সই করেন। এ ছাড়া, বাংলাদেশ এবং কুয়েতের মধ্যে সামরিক খাতে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহযোগিতা চুক্তিতে সই করেন কুয়েতের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রদূত খালেদ সুলায়মান আল জারাল্লাহ এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান। সবশেষে স্বাক্ষরিত হয় ঋণ সহায়তা চুক্তি। ‘বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কে পায়রা নদীর ওপর লেবুখালী সেতু নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে অর্থায়নের লক্ষ্যে কুয়েতের আরব অর্থনৈতিক উন্নয়ন ফান্ডের (কেএফএইডি) সঙ্গে স্বাক্ষরিত এ ঋণচুক্তিতে সই করেন কেএফএইডি’র মহাপরিচালক আবদুল ওয়াহাব আল-বাদর এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব মাহমুদা বেগম। এটি পায়রা ব্রিজ প্রকল্প নিয়ে দ্বিতীয় ঋণ চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় কুয়েতের ফান্ডের পরিমাণ ১৫ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার বা ৫০ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ। এর আগে, ২০১২ সালের মার্চ মাসে কেএফএইডি’র সঙ্গে আরেকটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে কুয়েতি ফান্ডের পরিমাণ ছিল ১৪ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার বা প্রায় ৪৮ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, টেররিজম এবং এক্সট্রিম ভায়লেন্সের বিষয়ে দুদেশের পলিসির প্রচুর মিল আছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন। চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কুয়েতের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন শেখ জাবের। উনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, কুয়েত কী কী ক্ষেত্রে, কী কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বৈঠকে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সহযোগিতার কথাও জানতে চেয়েছেন শেখ জাবের। শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘ এবং ওআইসির নেতৃত্বাধীন এইসব কাজ করে যাচ্ছে।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসলামিক উম্মা এবং সিরিয়া ও লিবিয়ার কথা এসেছে। এখন যে মুসলিম উম্মাহ একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, বিভিন্ন কনফ্লিক্টে বিভিন্ন এলাকায় যে নানা ধরনের সমস্যার তৈরি হয়েছে এবং বিভিন্ন কনফ্লিক্টের জন্য যে ডিসপ্লেসমেন্ট হচ্ছে, সেখানে কী কাজ করার আছে- তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ওআইসি, ইউএন এবং শান্তিরক্ষা মিশনে… সে বিষয়টি এসেছে। বিনিয়োগে সহযোগিতা বাড়াতে দুদেশের চুক্তির প্রসঙ্গ তুলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশে কুয়েতের বিনিয়োগকারীদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে কুয়েতের বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সংসদে কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী: এ ছাড়া দুই দিনের সফরকালে কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ অধিবেশন কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন। গতকাল বিকাল ৫টায় তিনি সংসদ ভবনে প্রবেশ করেন। এ সময় সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তাকে স্বাগত জানান। সোয়া ৫টায় অধিবেশন শুরু হলে তিনি অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন। শুরুতে স্পিকার কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির বিষয়টি অবহিত করেন। এ সময় এমপিরা টেবিল চাপড়ে তাকে স্বাগত জানান। এদিকে গতকাল বুধবার হওয়ায় অধিবেশনের শুরুতে ছিল প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্ব। তারকাচিহ্নিত প্রশ্নের পাশাপাশি সরকার ও বিরোধীদলীয় এমপিরা প্রধানমন্ত্রীকে সম্পূরক প্রশ্ন করেন। পুরো সময়টা উপভোগ করেন কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী ও সঙ্গীরা। কুয়েত প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি দলে ছিলেন, দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী খালেদ সুলেইমান আল-জারালাহ, শিক্ষা মন্ত্রী ড. বদর হামাদ আল-ইসাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এ ছাড়া কুয়েত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলও কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশ সফর করছেন।
দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর: কুয়েত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সমপ্রসারণ এবং বিনিয়োগ বাড়াতে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। সফররত কুয়েত চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (কেসিসিআই)’র বাণিজ্য প্রতিনিধি দল এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) নেতৃবৃন্দ আজ এক মতবিনিময় সভা করেন। এতে দু’দেশের ব্যবসায়ী নেতারা উভয় দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সমপ্রসারণে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে এফবিসিসিআই এবং কেসিসিআই নেতৃবৃন্দ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উন্নয়ন, প্রতিনিধিদল বিনিময় ও ব্যবসা নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির আশা রয়েছে। কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে কুয়েতের ওই ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করছেন।
কেসিসিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান ও কুয়েতের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবদুল ওয়াহাব এম. আল ওয়াযানের নেতৃত্বে কুয়েতের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা সভায় উপস্থিত ছিলেন। এফবিসিসিআইয়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন), সহসভাপতি মাহবুবুল আলমসহ পরিচালকরা সভায় অংশ নেন। কেসিসিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল ওয়াহাব এম. আল ওয়াযান বলেন, বাংলাদেশ ও কুয়েতের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা কুয়েতের বাজারে আরো বেশি পরিমাণে পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ নিতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও তিনি কুয়েতের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদেরকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। কুয়েত বিনিয়োগের জন্য বর্তমানে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত উল্লেখ করে তিনি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সেদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন, বর্ধনশীল প্রবৃদ্ধি এবং বিপুল সংখ্যক তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বিষয়টি উল্লেখ করে এফবিসিসিআই নেতৃবৃন্দ কুয়েতের ব্যবসায়ীদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আহ্বান জানান। তারা দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলসহ জ্বালানি, অবকাঠামো, থিম পার্ক, ফ্যাশনশিল্প ও অন্যান্য খাতে কুয়েতের বিনিয়োগ এবং যৌথ বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
এ ছাড়াও এফবিসিসিআই নেতারা বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কুয়েতের ভিসা পদ্ধতি সহজীকরণ, কুয়েতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার এবং কুয়েত ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের মধ্যে ‘যৌথ বিজনেস কাউন্সিল’ গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বাংলাদেশ ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে কুয়েতে ১৭ দশমিক ১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং কুয়েত থেকে ৮৫৯ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। বাংলাদেশ কুয়েতে মূলত কৃষিজাত পণ্য, নিটওয়্যার ও হিমায়িত খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *