হ্যাকিং নাকি বিশ্বসেরা রাবিশ ডাকাতি?

Slider ফুলজান বিবির বাংলা বিনোদন ও মিডিয়া

5442_f7

বাংলাদেশ ব্যাংকের রাবিশ পাহারাদারদের খুঁজে বের করুন। পাচার হয়ে যাওয়া আমাদের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিরিয়ে আনুন। একটি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে জনগণের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরির নেপথ্য নায়কদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে ফিলিপাইনে চলে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ও শ্রীলঙ্কায় আটকে যাওয়া ২ কোটি ডলার ফিরিয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মো. ফরাস উদ্দিন যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ জনসাধারণের সম্পদ। এর মালিক জনগণের পক্ষের সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক তার ম্যানেজার মাত্র।
তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবে বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে যারা কাজ করেন তারা খুবই দক্ষ সৎ কর্মঠ দেশপ্রেমিক ও নীতিবান। কিন্তু তিনি একথা বলার পরও মনে করেন, যারা রিজার্ভের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে কাজ করেন, তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমি যদি বলে দিই সবাই সন্দেহের ঊর্ধ্বে তাহলে কিন্তু তা ক্ষতিকর। নজরদারিতে রাখতেই হবে। হয়তো রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো রাখে না। টাকা যে চলে গেল, শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিন্তু তা ছাড়েনি। তাদের নজরদারির ব্যবস্থাটা অনেক বেশি কার্যকর। তার মানে আমাদেরটাও ফিলিপাইনের মতো কার্যকর নয়। ফিলিপাইনের কপাল ভালো থাকলে হয়তো উদ্ধার হতে পারে। তবে এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সুরক্ষা ব্যবস্থাটি অনেকটা নিশ্ছিদ্র করাটা। তিনি আরও বলেছেন, কিছুদিন আগে এটিএম কার্ড জালিয়াতি ঘটেছে। সারা পৃথিবী যখন ম্যাগনেটিক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে চিপস ব্যবস্থায় গেল, তখন আমরা গেলাম না। যখন গেলাম না তখন এত বুথ চালুর অনুমোদন দেয়া হলো কেন। কেন ম্যাগনেটিক ব্যবস্থা চালু রাখলাম? এটাতো গাফলতি ছাড়া কিছু নয়। এখনও ম্যাগনেটিক ব্যবহার করার যে এটিএম বুথ আছে সেগুলো দ্রুত বন্ধ করে দেয়া উচিত। বন্ধ না করলে ব্যাংক বাধ্য হবে না ব্যবস্থা নিতে। একইভাবে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা যে সফটওয়্যার আছে তাকে এমন লোক দিয়েই পরিচালনা করাতে হবে, যাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিরাপদ বলে ছাড় দিয়েছে। কারণ, ভেতরের কোনো সম্পৃক্ততা ছাড়া এ ধরনের হ্যাকিং সহজ নয়। কোনো অভ্যন্তরীণ সহায়তা পেলে এ ধরনের হ্যাকিং অনেক সহজ। তিনি এ মুহূর্তে কাউকে দোষারোপ বা সন্দেহের ঊর্ধ্বে না নিয়ে কার্যকর তদন্তের ওপর জোর দিয়েছেন।
দেশের মানুষ ড. ফরাসউদ্দিনের কথা বিবেচনায় রেখেই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংকের ভয়ঙ্কর লুটপাটের পর এতবড় পরিমাণের রিজার্ভের টাকা জালিয়াতচক্রের হাতে চলে যাওয়াকে হ্যাকিং নয় বিশ্বমানের অর্থ জালিয়াতি বলে মনে করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের মতো স্পর্শকাতর জায়গার কর্মকর্তা এবং সফটওয়্যার ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বশীলদের দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়েছে।
হ্যাক না ডাকাতি?
সাধারণত যখন বাইরের কোথাও থেকে গ্রুপ অপ হ্যাকার বা সাইবার হ্যাকাররা কোনো ইনফরমেশন সিস্টেম বা সফটওয়্যারের নিরাপত্তা বলয় ভেঙে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় তখন সেটিকে হ্যাক সিস্টেম বলে। সেটি হয় অতি সংগোপনে সবার অজান্তে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রগুলো দাবি করছে, লেনদেনের আদান প্রদানকারী ব্যবস্থা সুইফটের বাংলাদেশ ব্যাংকের অংশে ঢুকে দীর্ঘদিন ধরে পুরো ব্যবস্থাটিকে নজরদারিতে রেখেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে কী পরিমাণ অর্থ চলতি হিসেবে ছিল সেই তথ্যও জানানো হয়েছে। কি কি উদ্দেশ্যে ফেডারেল ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ চলতি হিসাবের অর্থ লেনদেন বা স্থানান্তরিত করা হতো এসব বিষয়েও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। ব্যাংকের দাবি এটি হ্যাক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশের রিজার্ভ মোট যে অর্থ, তার বড় অংশই বন্ডসহ বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ উপকরণে বিনিয়োগ করে রাখে। আর নিয়মিত লেনদেনের জন্য একটি অংশ রাখা হয় চলতি হিসাবে, যার পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারের মতো ছিল। ডাকাতচক্র এই চলতি হিসাবের ১০০ কোটি ডলারের পুরোটাই নিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের অথেনটিক ব্যবস্থা থেকে ৩৫টি পরামর্শ বা এডভাইসর পাঠানো হয়েছিল। যদিও তার মধ্য থেকে ৫টি পরামর্শ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায়। শ্রীলঙ্কায় যে এনজিওর নামে ২ কোটি ডলার গিয়েছিল সেই এনজিওর নামের বানান ভুল হওয়ায় রিজার্ভ ব্যাংক এটি আটকে দেয়। অন্যদিকে ফিলিপাইনের রিজার্ভ ব্যাংক সেটি ছেড়ে দেয়। এ টাকা সেই দেশের আইনের ফাঁক গলে বৈধ করতে কেসিনোতে ব্যবহারে হংকংয়ে পাচার হয়েছে বলে খবর এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা সাংবাদিকদের বলেছেন, ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানিলন্ডারিং কর্তৃপক্ষ তৎপর হওয়ায় কিছু টাকা ফেরত আনার বিষয়ে আশাবাদ জোরালো হচ্ছে।
এদিকে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে, একুশের বইমেলায় ঘুরে বেড়ানো, স্বাধীনতা পদক পাওয়া সৎ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এদেশের গণমাধ্যমে বিষয়টি আসার পর প্রথমদিন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, তিনি বিষয়টি জানেন না। পরের দিন তিনি বলেছেন, তাকে জানানো হয়েছে, এর দায় বাংলাদেশের ব্যাংকের নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকের। তদন্ত ও প্রমাণের আগেই অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্য সবাইকে বিস্মিত করে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের পরদিন সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, সুইফটের মাধ্যমে ৩০টি এডভাইজ চলে গেছে। প্রশ্ন আরও উঠেছে, ১০০ কোটি ডলার নিতে ৩৫টি এডভাইস বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩ ধাপে পাঠিয়েছে। এই তিন ধাপে যারা চেক করেছেন তাদের সবার পাসওয়ার্ড আলাদা। ফেডারেল ব্যাংক ৫টি এডভাইস কার্যকর হয়ে যাওয়ার পর সন্দেহজনক মনে হলেও এখানে তিন ধাপ কী করেছিল? ফেডারেল ব্যাংক ৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংককে এটি অবহিত করলেও জনগণের সম্পদ চুরির ঘটনা অর্থমন্ত্রীকে কেন জানানো হলো না? ২৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের গণমাধ্যমে এই জালিয়াতির খবর প্রকাশ হলে এদেশের গণমাধ্যম এটিকে লুফে নেয়। তার তিনদিন পর বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করে ফেডারেল ব্যাংক থেকে হ্যাকিং করে এটি ঘটানো হয়েছে। এখানে তাদের কোনো দায়িত্ব নেই। ফেডারেল ব্যাংক বলেছে, তাদের ওখান থেকে হ্যাকিং হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি নিশ্চিত হয় ফেডারেল ব্যাংকে হ্যাক হয়েছে তাহলে তাদের সঙ্গে দেনদরবার, প্রয়োজনে মামলায় না গিয়ে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় দৌড়াচ্ছে কেন? এতবড় বিশ্বসেরা হ্যাকিং বা ডাকাতির ঘটনায় জনগণের ১০ কোটি ডলার বাইরে চলে যাওয়ার পর কৃষিবান্ধব, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সৎ গভর্নর ড. আতিউর রহমান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অনুষ্ঠানের যোগ দিতে কিভাবে দিল্লি গেলেন। সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলতে বুঝায় যখন কোনো ইনফরমেশন সিস্টেম তার দায়িত্বরত কর্মকর্তা অফিসের আইন কানুন অমান্য করে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা সঙ্ঘবদ্ধচক্রের স্বার্থে এটির অপব্যবহার করে সেটি হচ্ছে সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ব্যাপারটা এমন, নিরাপত্তা প্রহরীর হাতে ঘরের সব মালামাল চুরি যাওয়া। ছোটখাটো সম্পদ যখন মালিকের আড়ালে তছরুপ হয় তখন তাকে বলা হয় চুরি। কিন্তু যখন বড় সম্পদ মালিকদের চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেটাকে বলে দিনদুপুরে ডাকাতি।
১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠান ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। সম্পদের দিক দিয়ে সেটি বৃহত্তম রিজার্ভ ব্যাংক। সুরক্ষিত ও অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ফেডওয়ার নামের পেমেন্ট সিস্টেম সফটওয়্যারের মাধ্যমে সব আর্থিক তহবিল স্থানান্তর বা লেনদেন করে থাকে যা কিনা হ্যাকড হয়ে গেলে পুরো পৃথিবীর ২৫০টা সেন্ট্রাল ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের রিজার্ভ ফান্ড স্থানান্তর ব্যবস্থা পুরোটাই ভেঙে পড়বে। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে বিদেশি বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা নেবে। সুইফট কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে বার্তা (ওয়ার) বিনিময় হয়েছে, সেটি ছিল বিশ্বাসযোগ্য (অথেনটিক)। এখন পর্যন্ত আমাদের নেটওয়ার্ক অপব্যবহার হয়েছে। দেশের আইটি বিশেষজ্ঞ বলছেন, এই অথেনটিক শব্দের মানে হলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো সুইফট কোড দিয়ে এ টাকা পাচার হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ কোড পাঠানোর সঙ্গে জড়িত। শ্রীলঙ্কায় পাচার করতে যাওয়া ২ কোটি ডলার মূল্যের অর্থ স্থানান্তর করতে গিয়ে হ্যাকাররা বানান ভুল করে ফেলে। যে কারণে ফেডারেল ব্যাংক টাকাটা ছাড় দেয়নি এবং এ নামের কোনো এনজির হদিসও মিলেনি। প্রশ্ন উঠেছে, এটি বিশ্বসেরা ব্যাংক ডাকাতি না হ্যাকিং? ফিলিপাইনের জালিয়াতচক্রের হাত ঘুরে হংকংয়ে চলে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার কী ফিরে পাওয়া আদৌ সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের ১ মাসের নীরবতা কী এই আন্তর্জাতিক জালিয়াতির ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা ছিল?
মানুষ চায় নিরপেক্ষ শক্তিশালী তদন্ত এবং তাদের সম্পদ ফিরে পেতে। বিশ্বের ব্যাংক ইতিহাসে ২০০৩ সালে সাদ্দামপুত্র পিতার নির্দেশে ১ বিলিয়ন ডলার ইরাকের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাচার করেছিলেন। সেই ঘটনার পর বিশ্বের ব্যাংকিং ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় স্ক্যান্ডাল। মানুষের চোখে মুখে বানান ভুলের কারণে আটকে দেয়া ২ কোটি ডলার ফেরত পাওয়া গেলেও তাকে জানানো হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা অন্যতমই নয়, বিস্ময়করও। এই টাকার মালিক দেশের জনগণ।
লেখক: প্রধান সম্পাদক: পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *