১৯৬৯ সাল। আমি তখন চলচ্চিত্রে মোটামুটি ব্যসত্ম নায়ক। তবে নিজের কোনো বাড়ি ছিল না। ভাড়া বাড়িতে থাকি। আজ এখানে তো কাল সেখানে। তখনকার দিনে ঢাকা শহর এত ব্যসত্ম ছিল না। এত বাড়িঘর, দালানকোঠা কিছুই ছিল না। বাড়ির পাশে ধু ধু মাঠ, ধানের জমি আবার পাশেই হয়তো দুই-একটি বাড়ি। এরকমই পরিবেশ। ভাড়া বাড়িতে আর কতদিন থাকব? চলচ্চিত্রের ব্যসত্ম নায়ক। নিজের একটা বাড়ি না থাকলে কী চলে? মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই দরকার। যা হবে একেবারেই নিজস্ব, আপন জায়গা। মনে মনে জমি খুঁজছিলাম। জমি কিনে বাড়ি বানাব। এমনই পরিকল্পনা। তখনকার দিনেও জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে ‘ব্রোকার’ ছিল। যার কাজই ছিল জমি কেনাবেচায় সহযোগিতা করা। আলী সাহেব নামে একজন ব্রোকারের সাথে আমার পরিচয় হলো। টয়োটা গাড়ি চালাতেন। ভিআইপিদের জমি কেনাবেচায় সহযোগিতা করতেন। যাকে বলা হতো ভিআইপি ব্রোকার। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী এলাকায় জমি কেনাবেচায় সহযোগিতা করতেন তিনি। আমাদের ক্যাপ্টেন (পরিচালক এহতেশাম) সাহেবকে তিনি খুব শ্রদ্ধা, সমীহ করতেন। একদিন আলীকে কাছে পেয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে দেখিয়ে বললেন, শোনো, হিরো রাজ্জাক সাহেবের জন্য একটা জমি দরকার। দেখো তো তাকে হেল্প করতে পার কি-না। ক্যাপ্টেন সাহেবের কথা শুনে আলী আমার দিকে তাকালেন। বোধকরি সিদ্ধানত্ম নিতে পারছিলেন না আমাকে কোন এলাকার জমি দেখাবেন। একপর্যায়ে দায়সারাভাবে বললেন, সামনের রোববার আপনি তৈরি থাকবেন। আমি আপনাকে জমি দেখাতে নিয়ে যাব। আমি তখন দিলু রোডে ভাড়া বাসায় থাকি। নির্ধারিত দিনে আলী সাহেব আমাকে নিতে এলেন। আমার তখন একটামাত্র গাড়ি হয়েছে। ডাটসন ব্লু বার্ড। আমাদের বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান আফজাল সাহেবের শাশুড়ির কাছ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় এই গাড়ি কিনেছিলাম। আমি নায়ক হিসেবে তখন ভীষণ জনপ্রিয়। কিন্তু অর্থকড়ি তো তেমন হয়নি। ইন্ডাস্ট্রি তখনো দাঁড়ায়নি। অভিনয় করে কতইবা পাই? এই ধারণায় আলী সাহেব ইন্দিরা রোডে এক ঘিঞ্জি জায়গায় আমাকে জমি দেখাতে নিয়ে গেলেন। আমার তো মন খারাপ। কারণ ব্রোকার আলী ধরেই নিয়েছেন ইন্দিরা রোডের এই ধরনের জমিই আমার কেনার ক্ষমতা আছে। গুলশান, বনানীর জমি আমি কিনতে পারব না। সে সামর্থ্য আমার নেই। আলী আমাকে ছোট ছোট জমি দেখাচ্ছেন। এটা কিনতে পারেন। ওটা কিনতে পারেন। এটা আপনার জন্য বেশ সসত্মা হবে… এভাবে নানা কথা বলছিলেন ব্রোকার আলী। আমি তাকে হতাশ করে দিয়ে বললাম, জমি দেখব না চলেন যাই।
আলী আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন। প্রশ্ন করলেন, কোনো সমস্যা? কী হয়েছে বলেন তো।
উত্তরে আমি বললাম, কোনো সমস্যা হয়নি। তবে কথা কি জানেন? আমরা শিল্পী। এরকম ঘিঞ্জি জায়গায় বাড়ি বানালে… তার চেয়ে চলেন আজ যাই…
আলী বোধকরি একটু বিরক্ত হলেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবজ্ঞার সুরে প্রশ্ন করলেন, আপনি তাহলে কী চান? আপনি কি ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীর দিকে জমি কিনতে চান?
আমি বললাম, ধানমন্ডিও কনজাসটেড… গুলশান অথবা বনানীর দিকে হলে ভালো হয়।
আমার কথা শুনে আলী এবার সত্যি সত্যি অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকালেন। ভাবটা এমন এই লোক বলে কী? গুলশান, বনানীতে জমি কিনতে কত টাকা লাগে সেটা জানে? শখ কত!
আলীর ব্যাপারে আমি মোটেও আহত হলাম না। কারণ আমার চাওয়াটা সব সময়ই বড় ছিল। পাই বা না পাই সব সময়ই বড় কিছু আশা করেছি এবং সেজন্য কঠিন সংগ্রামও করেছি।
গুলশান তখন মোটামুটি বড়লোকদের আভিজাত্যপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। পশ এলাকা যাকে বলে। আলী সাহেব একদিন আমাকে প্রশ্ন করলেন আপনি যে গুলশানে জমি কিনতে চাচ্ছেন জমির দাম জানেন?
ইন্দিরা রোডের থেকে কয়েকগুণ বেশি হবে। আমি বললাম, তাতে কি হয়েছে। আপনি গুলশানেই জমি দেখান।
অবশেষে আলী সাহেব গুলশানেই আমাকে জমি দেখাতে নিয়ে গেলেন। প্রথম যে জমিটা দেখালেন সেটাই আমার পছন্দ হলো। এক বিঘা ৫ কাঠা জমির পুরোটাই প্রায় ফাঁকা। মাঝে মাঝে কিছু কাঁঠাল গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। আলীকে বললাম, জমি আমার পছন্দ হয়েছে। আমার কথা শুনে আলীর সন্দেহ যেন কাটেই না। সেটা প্রকাশও করলেন, এই জমির অনেক দাম হবে। পারবেন?
উত্তরে বললাম, পারব। আপনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।
আলীর মন থেকে সন্দেহ যাচ্ছে না। তবুও তিনি একদিন আমাকে জমির মালিকের অফিসে নিয়ে গেলেন। ডিআইটির সামনে জমির মালিকের অফিস। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন সাহেব একাধিকবার আলীকে আমার জমি কেনা বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। উর্দুতে কথা বলতেন ক্যাপ্টেন। একদিন আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, রাজ্জাক সাহেবের জমির কি হলো?
আলী উত্তর দিয়েছিলেন, রাজ্জাক তো গুলশানে অনেক দামের জমি কিনতে চায়। আলীর কথা শুনে ক্যাপ্টেন ধমকের সুরে বলেছিলেন, রাজ্জাক যা চায় তাই দেখাও। আরে ব্যাটা এই রাজ্জাককে দেখতেছ, ও একদিন অনেক বড় হবে। অনেক নামীদামি লোক হবে। আমার ব্যাপারে ক্যাপ্টেনের এত বড় প্রত্যাশার কথা আলী ভরসা পাচ্ছিলেন না। হেলাফেলায় তিনি আমাকে গুলশানের জমির মালিকের অফিসে নিয়ে গেলেন। এই অফিসেই ঘটল একটি চমকপ্রদ ঘটনা। সালেজী নামে এক ভদ্রলোকের সাথে এই অফিসে আমার দেখা হলো। যার সাথে ঢাকা ক্লাবে আমার আগে পরিচয় হয়েছিল। আমার অভিনয়ের ভক্ত তিনি। নিজের অফিসে আমাকে দেখে খুশি হয়ে জানতে চাইলেন, আরে রাজ্জাক তুমি এখানে? সবকিছু খুলে বললাম তাকে। পাশেই বসা ছিলেন জমির মালিক। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি জমি কিনবে?
বললাম, হ্যাঁ।
মোহাম্মদ আলীর সন্দেহ কিন্তু তখনও কাটেনি। মাঝখানে তিনি বলার চেষ্টা করলেন, উনি জমি দেখেছেন। কিন্তু জমির যে দাম তাতে বোধহয়…
আলীকে থামিয়ে দিয়ে জমির মালিক আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি জমি কিনবে?
বললাম, হ্যাঁ।
তুমি জমি দেখেছ?
হ্যাঁ।
তোমার ওয়াইফকে দেখিয়েছ?
হ্যাঁ।
আমার কথা শুনে জমির মালিক কি যেন ভাবলেন। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন- কত টাকা দিতে পারবে?
আমি বললাম, টাকার কথা এখন বলতে পারব না। বাসায় গিয়ে ভেবে তারপর বলব।
আমার কথা শুনে জমির মালিক বললেন, ঠিক আছে বাসায় যাও। সবকিছু ভেবে সিদ্ধানত্ম নিয়ে আমার কাছে আসবে। জমির মালিক যখন আমার সাথে এসব কথা বলছিলেন তখন মোহাম্মদ আলী বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। তখন ৫/৭ হাজার টাকার হিরো আমি। আমি কী পারব গুলশানে জমি কিনতে? এটাই বোধকরি তিনি ভাবছিলেন।
যাহোক বাসায় ফিরে এসে আমার সেক্রেটারিকে জিজ্ঞেস করলাম, দেখো তো ব্যাংকে আমার কত টাকা আছে?
সেক্রেটারি জানতে চাইল, কেন স্যার?
তাকে জমি কেনার কথা বললাম। সে হিসাব করে বলল, ব্যাংক থেকে আপনাকে বড়জোর ২৫ হাজার টাকা দেয়া যেতে পারে।
মনে মনে ভাবলাম মাত্র ২৫ হাজার টাকায় কি এতবড় জমি কেনা সম্ভব হবে? তবুও বুকে সাহস নিয়ে বললাম, কাল ব্যাংক থেকে টাকাটা তুলে আমার হাতে দিও। জমি কিনতে যাব।
পরের দিন ছবির শুটিং ছিল। ক্যাপ্টেন সাহেবেরই ছবি। তাকে জমির কথা বলতেই দ্বিগুণ উৎসাহে বললেন, শুটিং পরে হবে। আগে জমির ব্যাপারটা দেখো… আমার চেয়ে ক্যাপ্টেন সাহেবের আগ্রহই যেন বেশি। তিনি বেশ খুশি।
জমি কিনতে গেলাম। সালেজী বসেছিলেন। তাকে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে বললাম, আমার কাছে এই টাকাই আছে…
সালেজী আমাকে থামিয়ে দিয়ে একটা ফাইল হাতে তুলে দিলেন। ফাইলের ভিতর জমির কাগজপত্র। একবিঘা ৫ কাঠা জমির মূল্য তখন ধরা হয়েছিল ৬০ হাজার টাকা। আমার জন্য সেটা করা হলো ৪৫ হাজার টাকা। ২৫ হাজার টাকা দিয়ে যখন তাকে বললাম, আমার কাছে এখন এই টাকাই আছে।
সালেজী সাহস দিয়ে বললেন, আরে ব্যাটা ঠিক আছে। জমি এখন তোমার। বাকি ২০ হাজার টাকা তুমি মেরে খেলে খাবে…. হাঃ হাঃ হাঃ
জমির বাকি ২০ হাজার টাকা দ্রুতই শোধ করেছি। অতঃপর ৪৫ হাজার টাকায় এক বিঘা ৫ কাঠা জমির মালিক হবার সৌভাগ্য হলো। যে জমিতে এখন আমার বাড়ি। যে বাড়িতে আমার পরিবারের সবাই থাকে।