যেসব ‘যুক্তি’তে সাঈদীর ফাঁসি পুনর্বহাল চান রাষ্ট্রপক্ষ

Slider বাংলার আদালত

2015_08_23_14_51_19_QWWSJ03OGci4LKBHPu2DTE3QThh3m9_original

 

 

 

 

ঢাকা: চারটি অভিযোগের বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড পুনর্বহালের আর্জি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষ। সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনে এ চার অভিযোগের বিষয়ে পাঁচটি যুক্তি তুলে ধরা হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে করা রিভিউ আবেদনে দেখানো যুক্তিগুলো এখনই প্রকাশ করতে চাননি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তবে যেসব অভিযোগের বিষয়ে যুক্তি দিয়েছেন সেগুলো সাংবাদিকদের কাছে উল্লেখ করেছেন তিনি।

মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) রিভিউ দায়েরের পর নিজ কার্যালয়ের অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপিল বিভাগ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা ‍রাষ্ট্রপক্ষ আজকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একটি রিভিউ পিটিশন দায়ের করেছি। যার নম্বর হলো ০৩/২০১৬।’

‘এ রিভিউ পিটিশন দায়ের করে আমরা বলতে চেয়েছি, ইব্রহিম কুট্টি ও বিসাবালী হত্যার দায় থেকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কোনো প্রকার অব্যাহতি পেতে পারেন না। এবং তাকে যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো সেটা পুর্নবহাল করার জন্য আমরা আমাদের আবেদনে উল্লেখ করেছি।’

কি যুক্তিতে মৃত্যুদণ্ড পুনর্বহালের আর্জি জানিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমাদের যুক্তিগুলো পিটিশনে উল্লেখ করেছি। সেটা মামলা যখন শুনানি হবে তখন জানতে পারবেন। আদালতের কাছে যে বক্তব্য জমা দিয়েছি, সেটা এখনই আপনাদের কাছে বলা সমীচীন মনে করি না’।

মোট কতোটি যুক্তি দিয়েছেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের ৫টি যুক্তি। আমরা যুক্তিতে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি, যে অপরাধ তিনি করেছেন, সে অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি তার পাওয়া দরকার। এখানে আমরা বেসিক্যালি চারটি চার্জের ব্যাপারে আমাদের অভিযোগগুলো বা আমাদের যুক্তিতর্কগুলো তুলে ধরেছি’।

‘একটি চার্জ হলো, মাখন সাহার দোকান থেকে ২২ কেজি সোনা-রুপা লুট হয়েছিলো। আরেকটি হলো শেফালী ঘরামীকে যে ধর্ষণ করা হয়েছিলো, সে ব্যাপারে। আরেকটি চার্জের ব্যাপারে আমরা রিভিউ করেছি। সেটি হলো, ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার ব্যাপারে এবং সর্বশেষ বিসাবালীকে হত্যার ব্যাপারে’।

শেফালী ঘরামীর বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, শেফালীকে ধর্ষণ করা হয়েছে তার স্বামীর এ বক্তব্য আদালত বিশ্বাস করেননি। আমরা বলেছি, যেখানে তার স্বামীই বলছেন, তার স্ত্রী ধর্ষিত হয়েছেন। সেখানে তারা বলছেন কিভাবে যে, তিনি (সাঈদী) কোলাবরেট করেননি? অন্য সাক্ষীরাও বলেছেন, ওই সময় (একাত্তর সালে) পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বা রাজাকাররা মানুষের বাড়িতে আসতো। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো, সম্পত্তি হরণ ও লুট করা আর নারীদের সম্ভ্রম নষ্ট করা। সে সময় প্রতিটি পরিবার দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকতো যে পরিবারে যুবতী নারী বা যুবতী মেয়ে থাকতো। তাদেরকে নিয়ে পরিবারগুলোর সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় থাকতে হতো’।

‘আমরা রিভিউ চেয়েছি, ট্রাইব্যুনাল যে উপযুক্ত দণ্ড দিয়েছেন, সেটা পুনরুদ্ধার করা’- বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

‘চার যুদ্ধাপরাধীর রিভিউ খারিজ হয়েছে। এখন এ রিভিউয়ে দণ্ড বাড়বে এ নিয়ে কি ভাবছেন?’- এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমরা আশাবাদী। প্রতিটি আইনে নতুনভাবে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। কাজেই রিভিউয়ে যে কোনো রকম দণ্ড বাড়বে না এটা স্বত:সিদ্ধ কথা না। এটা সম্পূর্ণ আদালতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরে নির্ভরশীল’।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সাঈদীর আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ চূড়ান্ত রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ।

৬১৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংক্ষিপ্তাকারে সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত এ রায় দেন আপিল বিভাগ।  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর মৃত্যুদণ্ডাদেশের সাজা কমিয়ে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।

সে সময়কার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এ রায় দেন। বিচারপতিদের মধ্যে মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা সব অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেন। আর বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী আসামির মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় দেন। তবে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মতামতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় আসে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২৮ মার্চ সাঈদী ও সরকারপক্ষ পৃথক দু’টি আপিল (আপিল নম্বর: ৩৯ ও ৪০) দাখিল করেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা ঘোষিত না হওয়া ৬টি অভিযোগে শাস্তির আর্জি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আর সাঈদীর ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আসামিপক্ষ আপিল করেন।

২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল আপিল মামলাটির শুনানি শেষ হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন আপিল বিভাগ। এর পাঁচ মাসের মাথায় সংক্ষিপ্ত রায়টি দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলো এরও এক বছর সাড়ে তিনমাস মাস পর।

সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয়জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং ১শ’ থেকে ১শ’৫০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরে বাধ্য করার মত ২০টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিলো ট্রাইব্যুনালে।

এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণের আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে দু’টি অপরাধে অর্থাৎ ৮ ও ১০নং অভিযোগে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়ার দায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। প্রমাণিত অন্য ৬টি অর্থাৎ ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯নং অভিযোগে আলাদাভাবে কোনো সাজা দেননি ট্রাইব্যুনাল।

আর সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ৫টি অভিযোগ। এর মধ্যে ২টিতে অর্থাৎ ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করায় আমৃত্যু এবং একটিতে অর্থাৎ ১০ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরে বাধ্য করা ও এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতার মতো অপরাধে যাবজ্জীবন পেয়েছেন সাঈদী। একটিতে অর্থাৎ ৮ নম্বর অভিযোগে হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে ফাঁসির রায় দিলেও আপিল বিভাগ অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অন্য অংশের জন্য খালাস দিয়েছেন। একটিতে অর্থাৎ ৭ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সহযোগিতার জন্য ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে সাঈদীকে।

এছাড়া ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ আপিল বিভাগের রায়ে প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি।

বাকি ১২টি অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৯, ১২, ১৩, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০ নম্বর অভিযোগে প্রমাণিত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে এসব অভিযোগ থেকে খালাস পান সাঈদী। রাষ্ট্রপক্ষ এসব অভিযোগে আপিল বিভাগের কাছে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘ন্যায়বিচার’ প্রার্থনা করেছিলেন। আপিলের রায়ে ট্রাইব্যুনালের এ খালাসের রায় বহাল রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *