হুমকির মুখে গণমাধমের স্বাধীনতা

Slider গ্রাম বাংলা জাতীয় টপ নিউজ ঢাকা বিনোদন ও মিডিয়া রাজনীতি সারাদেশ সারাবিশ্ব

35123_f3
গ্রাম বাংলা ডেস্ক: জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালাকে চরম অগণতান্ত্রিক ও শঙ্কাজনক বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, সংবাদমাধ্যম জাতির বিবেক। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে তা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে। দেশের মানুষকে তথ্য পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে। সমপ্রচার নীতিমালা তৈরিতে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়নি বরং দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা প্রণয়ন হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে টেলিভিশনে সংবাদ ও মতামত প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে দেশে গণতন্ত্র বিঘ্নিত হবে। কোন সরকারের উচিত নয়, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করা। এতে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আসলে বিধিনিষেধ দিয়ে কোন দিন গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সমপ্রচার নীতিমালা নিয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, টক শোতে এখন কথা বলার স্বাধীনতা রয়েছে। নতুন সমপ্রচার নীতিমালার কারণে ওই স্বাধীনতা কিছুটা খর্ব হবেই। এটাকে কেউ মিসইউজ (অপব্যবহার) করতে চাইলে করতে পারবে। টক শোতে অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য তোলা হচ্ছে কিনা এটা কে বিচার করবে, কে নির্ধারণ করবে? কারণ টক শো হয় আপনার মতামত, আমার মতামত, পারসেপশন, নিউজ, ভিউজসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তিনি বলেন, টক শো হয় একক কোন বিষয়ের ওপর। এতে রাজনীতিবিদ বা সমাজের বিশিষ্টজনরা তাদের মতামত দিয়ে থাকেন। গান, ফিল্ম, ইন্টারন্যাশনাল ইস্যু, টেকনিক্যাল বা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা টাইপের টক শো হয়। তাই সমপ্রচার নীতিমালায় কথা বলায় রেসস্ট্রিকশন আরোপ করলে আমরা যারা স্বাধীনভাবে কথা বলি, আর্টিকেল লিখি তাদের জন্য সমস্যা হবে। তিনি, সমপ্রচার নীতিমালায় যদি আদতেই বলা হয়ে থাকে অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য তোলা যাবে না তবে রেফারেন্স নিয়ে কথা বলতে হবে। কোন মতামত দিতেও চিন্তা করতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পার্শ্ববর্তী দেশে যা দেখছি গণমাধ্যমে কিছু বিষয়ে সেন্সর করে। আমাদের দেশেও কিছু বিষয়ে সেন্সর করা হয়। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সমপ্রচার নীতিমালায় যে সব কথা বলা হয়েছে তা আপাত দৃষ্টিতে ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবে ঠিক নয়। টক শোতে মিথ্যা বলা অনুচিত, সামপ্রদায়িক আদর্শ বিনষ্ট করাও উচিত নয়। কিন্তু সমপ্রচার নীতিমালার পুরোপুরি ব্যাখ্যা আসা উচিত। তিনি বলেন, স্বাধীন সমপ্রচার কি আসলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে? এদেশে যে সব কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করা উচিত ওই সব কমিশন কি ঠিকভাবে কাজ করে। তিনি বলেন, নতুন সমপ্রচার নীতিমালা গণতন্ত্রের পাশাপাশি আইনের শাসন ও অর্থনীতিকেও বাধাগ্রস্ত করবে। বিশ্বায়নের যুগে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিমালা কাম্য নয়। সংবাদ কর্মীরা এমনিতেই নীতিমালা মেনে কাজ করে থাকে। এ অবস্থায় যদি নীতিমালার নামে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা হয় তাহলে গণমাধ্যমের বিকাশের পথ রুদ্ধ হবে।   চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ বলেন, অনেক দিন পরে হলেও বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও’র জন্য খসড়া নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। একে সাধুবাদ জানাই। এটা সাংবাদিকদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু নীতিমালায় কিছু কিছু ব্যাপার পরিষ্কার করা প্রয়োজন ছিল। কটাক্ষ শব্দটির ব্যাখ্যা আরও পরিষ্কারভাবে হওয়া উচিত ছিল। বিস্তারিত বলা উচিত ছিল কটাক্ষ মানে কি? তারপর যেমন বলা আছে কোন ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় সেটি করা যাবে না। এখন প্রশাসন যন্ত্রের কেউ যদি কোন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয় তাহলে সাংবাদিকদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে সেটি রিপোর্টিং করা। এবং সেটি করলে ওই ব্যক্তির ভাবমূর্তিতো নষ্ট হবেই। সেটাই স্বাভাবিক। অতএব এই জায়গাগুলোর ব্যাখ্যা আরও পরিষ্কার হওয়া উচিত। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সমপ্রচার নীতিমালা নিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে সরকার। এ নীতিমালার মাধ্যমে নির্দেশিকা জারি করা ছাড়া ইতিবাচক দিক নেই। আমি মনে করি মিডিয়াকে এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। যা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় কাম্য হতে পারে না।
প্রস্তাবিত নীতিমালাকে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের একটি প্রয়াস হিসেবে দেখছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. পিয়াস করিম। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন কথা বলা যাবে না- এমন নীতিমালার বাস্তবায়ন হলে র‌্যাবের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। বাহিনীগুলোতে দলীয়করণ সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। অথচ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা মিডিয়াতে আলোচনার কারণেই উদঘাটিত হয়েছে। এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে গণমাধ্যমের অবাধ তথ্যপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটবে। তিনি আরও বলেন, যারা টকশোতে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করেন তারা বিষয়টি নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। এই সমপ্রচার নীতিমালা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।
বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সমপ্রচার নীতিমালার উদ্যোগটি ভাল, এটা আমরা অনেক দিন ধরে চাইছলাম। কিন্তু নীতিমালার খসড়ায় নানা ধরনের উদ্বেগ আছে। নীতিমালায় বর্ণনা করা বিষয়বস্তুর বিন্যাস ও বিজ্ঞাপন নীতিমালা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, আমরা যে ভাবে সমপ্রচার নীতিমালা চেয়েছিলাম সে ভাবে হয়নি। আমরা তথ্য মন্ত্রণালয়কে লাইসেন্সিং, চাকরি কাঠামো ও সুরক্ষা, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা এবং বিষয়বস্তু স্পষ্ট করার কথা বলেছিলাম। অনুমোদিত নীতিমালায় দেখতে পাচ্ছি তিনটিই নেই। শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন নীতিমালা ও বিষয়বস্তু রয়েছে। যা রয়েছে তা-ও নিয়ন্ত্রণমূলক। বর্তমানে আমরা দ্রুত সমপ্রচার কমিশন গঠনের জন্য সরকারের কাছে চাইছি। তবে সমপ্রচার কমিশন গঠনের বিষয়টিও অস্পষ্ট। চেয়ারম্যান বা সদস্য কোন প্রক্রিয়া ও যোগ্যতার বলে হবে তার কোন কথা বলা হয়নি। সদস্য সংখ্যার বিষয়টিও বলা নেই। মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, কমিশন কবে নাগাদ হবে তার কোন ঠিক নেই। এর চেয়ে ভয়ানক যে বিষয়টি তা হলো যত দিন কমিশন গঠন না হবে ততদিন তথ্য মন্ত্রণালয় নীতিমালার আওতায় সব কিছু দেখভাল করবে। নীতিমালায় কিছু ধারার কথা বলা হয়েছে যা অগ্রহণযোগ্য। যেমন বলা হয়েছে, এমন কোন নিউজ করা যাবে না যাতে সরকারি কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কিছু প্রকাশ হয়। তাহলে কি নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারে জড়িত র‌্যাবের তিন কর্মকর্তার বিষয়ে কি রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারবো না। বিজ্ঞাপনের বিষয়ে বলা হয়েছে, অডিও ভিডিও শ্রুতিমধুর হতে হবে। এটা কে ঠিক করবে? এখন আমরা চাইছি শক্তিশালী সমপ্রচার কমিশন গঠন করা হোক। এ কমিশনই সবকিছু ঠিক করবে। কলামনিস্ট মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ন্ত্রণমূলক। এ নীতিমালার চার ভাগের তিন ভাগই নিয়ন্ত্রণমূলক। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি না সরকারের হাতে স্বাধীনভাবে কোন কমিশন গঠিত হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশে সরকার দ্বারা গঠিত কোন প্রতিষ্ঠানই স্বাধীনভাবে কাজ করে না। আর নীতিমালা যদি প্রণয়নই করতে হয় তবে তা তো ওই কমিশনেরই প্রণয়ন করা উচিত। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবমাননাকর, সেনাবাহিনীর প্রতি অবমাননাকর কোন সংবাদ তো এমনিতেই প্রচার হয় না। এর জন্য আবার নীতিমালা প্রয়োজন হবে কেন? বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, সমপ্রচার নীতিমালাটি দরকার ছিল। এটি অনেকের দাবিও ছিল। কিন্তু নীতিমালায় বর্ণিত কমিশন গঠন নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। কমিশন কবে গঠন হবে, কারা থাকবেন- এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। যাদের জন্য নীতিমালা অর্থাৎ সাংবাদিক, কলাকুশলী এবং ব্যবসায়ীদের নিয়ে কোন কথা এ নীতিমালায় বলা নেই। তাই সঙ্কট তৈরি করে এমন কিছু নীতিমালার বরাত দিয়ে করা ঠিক নয়। এতে বরং সমস্যা বাড়ে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মোহসিন বলেন, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তথ্য সেটা কে যাচাই করবে? জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালার মাধ্যমে এই অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রত্যেকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কারও পছন্দ না হলে সেটা খণ্ডন করতে পারে। প্রয়োজনে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করতে পারেন। কিন্তু সরকার সেই সুযোগ না দিয়ে এই নীতিমালার মাধ্যমে জনগণের কন্ঠরোধের চেষ্টা করছে।
সিনিয়র সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেন, সমপ্রচার নীতিমালা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্নের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। এটি আসলে সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রক্ষাকবচের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। মিডিয়া কর্মীরা কি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতি, অপকর্মের সংবাদ পরিবেশন করবে না? নীতিমালার মাধ্যমে এটা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আসলে অনুমোদিত নীতিমালার মাধ্যমে গণমাধ্যমের হাত-পা কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। টক শোতে উপস্থিত গেস্টদের মতামত বাছবিচারের দায়িত্ব কে নেবে? আসলে ভিন্নমত দমনের জন্যই নীতিমালাটি তৈরি করা হয়েছে। কালোনীতিমালাটি বাস্তবায়নে সতর্ক না হলে শুরুতেই এটি বিতর্কিত হতে পারে।‘সাপ্তাহিক’ সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, স্বাধীনভাবে কথা বলার ক্ষেত্রে এটি অসম্মানজনক নীতিমালা। এতে নৈরাজ্য, ভাবমূর্তি বিনষ্ট, অবমাননাকর, কটাক্ষ, অসত্য, বিভ্রান্তিকরসহ আরও কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেগুলো আসলে বায়বীয় শব্দ। এর ফলে আইনটি বাজে ভাবে ব্যবহার হবে। অসৎ ব্যক্তিরা আইনটি বাজে ভাবে ব্যবহার করবে। যা স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেন, টক শোতে অসত্য তথ্য তোলা হয় না। সরকার মনে করছে এ নীতিমালাটি করে দমন নিপীড়ন চালাতে পারবে। টক শো বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ নীতিমালাটি করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, আমরা এ সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে শঙ্কিত। এটা চরম অগণতান্ত্রিক। এ নীতিমালার মাধ্যমে সরকার টক শোসহ বিভিন্ন প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যেসব অনুষ্ঠান সরকারের পছন্দ হবে না সে সব অনুষ্ঠানকে সরকার তার নিজের ভাষায় রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে অভিহিত করবে এবং বন্ধ করে দেবে। গ্রেপ্তার করবে আলোচকদের। আমরা এ নীতিমালা প্রত্যাখ্যান করছি। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো উচিত। আমরা এর বিরুদ্ধে মাঠে নামবো। (সুত্র মানবজমিন)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *