অভিন্ন অনুভব

সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

 

2015_11_07_14_13_08_GOCKbnF2YgqgNUtOukYGtouezAAA2E_original

 

 

 

 

মেহেরুন নেছা রুমা

সেবারও এমনই হয়েছিল। প্রতিবারই এমন হয়ে শেষ পর্যন্ত শেষই হয়ে যায় সবকিছু। খুব কষ্ট পায় রেণুকা। আঘাতে আঘাতে মনের পাঁজরের  হাড়গুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে জীবনটা কেবল ফাঁকা ফাঁকা লাগে। প্রথমবার  মনে হচ্ছিল এমন ঘটনা জীবনে কেবল একবারই হতে পারে, একবারই আসে ভালোবাসা-জীবনে, এবং হারিয়ে গেলে তা আর কখনোই ফিরে আসে না। এমন কষ্টের দহন, দহনের কষ্ট জীবনে বারবার আসা কিছুতেই সম্ভব না। কিন্তু রেণুকার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে দ্বিতীয় কেউ আসল জীবনে। দ্বিতীয়’র সাথে সাথে, হ্যাঁ, ধরতে গেলে একই সমান তালে, হয়তো’বা একটু আগ-পিছ করে তৃতীয়, চতুর্থবারও হল। প্রায় কাছাকাছি গল্প, চরিত্র, কাছাকাছি অনুভূতি আর কষ্টের দাগগুলোও ছিল প্রায় একই রকম গভীর, খাঁজকাটা বেদনাদায়ক। সেসব উতরেও এসেছিল রেণুকা। আসতে কী পেরেছিল সে? কী যন্ত্রণাই না পোহাতে হল ঘরে -বাইরে। তখন মনে হত এর চেয়ে মরণও ভাল এবং সহজ। কিন্তু জীবনের প্রতি মায়া সে ওতো কম নয়। তাইতো উতরে ওঠে সে। বেঁচে থেকে ভালই হল। আরো পাওয়া হল, কষ্টেরও কমতি ছিল না। শুধু কি কষ্টই? অস্বীকার সে করবে না। সত্যি সুখও ছিল ঢের। প্রতিবারই মুঠো মুঠো সুখ এসেছিল জীবনে আলো হয়ে। এক একবার মনে হত এত সুখ জীবনে যদি লেখাই ছিল তবে কেন আরও আগে ধরা দিল না?
সবগুলোর একই রূপ। রেণুকা কী সেধে গিয়েছিল? না, কারো কাছেই সে সেধে যায়নি। কেমন করে ঘটে গেল প্রথমবার! কত পালিয়ে ছিল রেণুকা। তবু ধরা দিতে হল। হার মেনেছিল সে। হার মেনে ধরা দিয়ে পরে মনে হল জয়লাভ করেছে। এমনটাই তো হওয়ার কথা জীবনে। নইলে আর কীসের জীবন। এতদিন কী পেয়েছিল? কিছুই না। কাঁচা সোনার মত রং, প্রতিমার মত রূপ সেই কৈশোর থেকেই লালন করে আসছে। লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। এত রূপ নিয়ে কী লেখাপড়া সম্ভব? অল্প বয়সেই ঠিকাদারের বউ হয়েছিল রেণুকা। কিন্তু সুখী হয়নি প্রথম থেকেই। তবু সুখী সুখী চেহারা আর সংসারের ঠমক দেখে মানুষ উদাহরণ দিয়ে বলত, গিয়ে দেখ রেণুকার সংসার। তোরা পারিস ওর মত? কত্ত সুখ মেয়েটার! আর শরীরটাও ছিল যেন বাঁধা ছাটা। এতটুকু মেদ জমেনি কোথাও। পুলিশের বড় অফিসার ডালিম, রেণুকাদের প্রতিবেশী। যার কাছে রেণুকার স্বামীর কোনমতেই পাত্তা পাওয়ার কথা না। সেও একসময় রেণুকার জন্যই তার স্বামীর সাথে বন্ধুত্ব করল। ডালিমের কাছে রেণুকা যেন চাঁদের কণা। কত্ত গোছানো একটা মেয়ে। ঘরের কাছে এমন খাটি সোনা! একে পাওয়ার জন্য ঠিকাদার কেন, সদর ঘাটের কুলির সাথেও এক থালায় ভাত খাওয়া যায়। ধন্য হয়েছিল ঠিকাদার কাওসার। কোলে রাখি না মাথায় রাখি; এমনি আদর আপ্যায়নের সাথে ডালিমকে ঘরে নিয়ে আসত রোজ। রেণুকার হাতের একটু যত্নআত্তির সহিত এক কাপ চা খাওয়ার অভ্যাসটা এই ঘরেই হয়ে উঠল ডালিমের। চায়ের তেষ্টার সাথে আরও কিছুর তেষ্টা।

সেসব দিনগুলোর কথা কেমন করে ভুলবে রেণুকা। সেই দিনটিতে আকাশ ফেটে ঝড় নামল, প্রতিবেশী ডালিম দেখল উদ্ভ্রান্ত রেণুকা গায়ে মাথায় কাপড় নেই, ছুটছে দিগ্বিদিক। ঠিকাদার স্বামীকে  কে বা কারা আটকে রেখেছিল। ডালিমই তাকে ছাড়িয়ে আনে। রেণুকার কপাল থেকে দুশ্চিন্তার গভীর রেখাটা মুছে দেয়ার দায়িত্বখানি তার হাতেই বর্তায়। পুরো ঘটনাটি সাজানোও মনে হয়েছিল একবার, রেণুকার কাছে। এভাবে আরো কত কি সাহায্য। সবই করেছিল রেণুকার জন্য। সেই আকাশ ফাটা ঝড়ের সন্ধ্যায় রেণুকার চোখের দিকে তাকিয়ে একটুখানি কৌশলে ডালিম বলেছিল শুধু একটি মাত্র কথা- ‘এমন ফুলের মত মেয়ে, কত গভীর দু:খ পুষে রেখেছ আপন মনে, যা কাউকেই বলতে পারছ না’। জীবনে প্রথম মনে হল মনের ঘরে কেউ উঁকি মারল, কেঁপে উঠেছিল রেণুকা। পালিয়ে গিয়েছিল ডালিমের সামনে থেকে। এরপর সপ্তাহ খানেক সামনে আসেনি। ডালিমের চোখের ভেতর দেখতে পেয়েছিল নিজের সর্বনাশের ছায়া। কেমন করে জানল লোকটা? রেণুকার কাছে সে এক আশ্চর্যের  বিষয় । তার দু:খ তারই ছিল। কাউকে তো বলতে যায়নি কখনো। সবাই তো তাকে সুখীই জানে। কেমন করে এতকাল পরে এই একটি মানুষ তার মনের অতি গভীরের বন্ধগলিতে প্রবেশ করল? বারবারই পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যাচ্ছিল রেণুকা। ডালিমও যেন পিছু ছাড়ার পাত্রটি নয়। রেণুকাকে জয় করতেই হবে। আপন সংসার পিছনে ফেলে রেণুকার জন্য জলাঞ্জলি দিবে জীবনের সকল অর্জন। রেণুকার হাত ধরে সুখী হবে। সব প্রতিশ্র“তি আছড়ে পড়তে থাকল রেণুকার পদতলে। না পেরে উপায় আছে? যে  দেবতা জেনে গেছে তার মনের গলি, তাকে মন থেকে এড়ায় কী করে।

মনের পাঁজর ভাঙা কষ্ট। দ্বিতীয়বার, কিছুটা সময় নিয়ে একটু একটু করে এগিয়েছিল রেণুকা।  সেবারও কিছুতেই চায়নি সে। তবু মন দিতেই হল। আবির তখন রেণুকার দু’বছরের ছোট। কোন কিছু দিয়ে যখন আবিরকে এড়ানো যায়নি, তখন এই বয়সের দেয়ালটা বারবার দাঁড় করছিল রেণুকা, আর বারবারই আবির তা লাথি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে মনের সাথে মন মিশে একাকার হয়ে  গেছে, সেখানে এই সামান্য বয়সের ছোট-বড় নিয়ে যারা ভাবে তারা সংকীর্ণমনা বৈ কিছুই নয়। তীব্র আকর্ষণ হত আবিরের প্রতি। আবিরের ছোট ছোট কথা, হাসি, কী মায়া! শেষে ভালো না বেসে কী পারা যায়? একইরকম আকর্ষণ অনুভব করত ডালিমের প্রতি।  শেষে কত কষ্টই না দিয়েছে ডালিম। তাইতো আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল আবিরের কাছে। কে বলছে মানুষের জীবনে একবারই প্রেম আসে? সব ফালতু কথা। এইতো, রেণুকার জীবনে চার চারবার এসেছে। একই মানসিক সুখ, শরীরের আকর্ষন, একই রকম কষ্ট আর কাছে পাওয়ার ব্যকুলতা। আবার একই রকমভাবে কষ্ট দিয়ে তারা একে একে ত্যাগও করেছে রেণুকাকে। ফের একই ভাবে ফিরেও এসেছে।

সব দিয়েছিল রেণুকা। ভাবল, ভালোই যখন বাসব তো দিতে দোষ কি? আর তার জীবনে তো এসব পাওয়াই হয়নি। কত সহ্য করতে হয়েছে স্বামীর অক্ষমতার অত্যাচার। রাতের পর রাত সহস্রবার মৃত্যুবরণ করে ভোরবেলা সুখী হওয়ার ভান। আর কত! এবার না হয় সত্যিকারের একটু সুখী হই। তাই মনের সমস্ত  প্রেম জেগে উঠেছিল আপনা আপনি। সুখী হয়েছিল ডালিম। এ কেমন আশ্চর্য মেয়ে! এর কাছে না আসতে পারলে সকল কর্মই বৃথা। একইভাবে দ্বিতীয়বারও, আবীরও পেয়েছিল অনেক। দিতেও কার্পণ্য করেনি কিছু। বিয়ে করার জন্য পাগল হয়েছিল সে। ডালিমের বেলায়ও সেই চেষ্টা হয়েছিল চরমরূপে। শেষে অনেক জেদাজেদি অনেক সাধাসাধির পর রেণুকা যখন কাওসারের ঘর ছেড়ে ডালিমের বউ হতে চাইলো, তক্ষুনি টনক নড়ল ডালিমের। এতো সাংঘাতিক ঘটনা। সমাজে মান থাকবে না। আবার প্রথম স্ত্রীর হাত থেকে রক্ষাও পাওয়া যাবে না। মামলা মকদ্দমায় গেলে চাকরিটাও হারাতে হবে। রেণুকাকে এড়িয়ে চলে, তবু রোজ কাছে আসতে ভুলে না। কথার চেয়ে কাজটাই বেশি প্রাধান্য পায়। রেণুকা বুঝতে পারে, মনের আবেগ মরে গিয়ে এখন শরীরের প্রবল প্রবাহ ধরে রাখছেন ডালিম। রেণুকাকে কেন্দ্র করেই সংসারে অশান্তি। বলল, যেমন আছি তেমনই থাক, বিয়ের দরকার কি, আলাদা সংসারে থেকেই সব হবে। দরকার হলে তোমার পুত্রের আশাও পূরণ করব। ভরন পোষণ আমিই দেব। তবু বিন্তীর মাকে খেপিয়ে লাভ নেই। ও বড় জেদি  মেয়ে। রেণুকার তখন কঠিন অবস্থা। ডালিমকে ছাড়া জীবন অন্ধকার। কাওসারও যখন জেনে ফেলেছে তখন আর ওই সংসারে আত্মসম্মান নিয়ে বসবাস সম্ভব নয়। আর যেখানে মনের ক্ষুধা মনেই রয়ে যায়, তবু জীবন পার হয়ে যায় ভাঙ্গা আয়নার মত, সেই জীবনের আর কি পিছুটান? শেষে অবস্থা বেগতিক দেখে ডালিম দিল যোগাযোগ বন্ধ করে। এই মেয়ের সাথে চুরি করে প্রেম করাই সম্ভব, বিয়ে করে সমাজের চোখে ছোট হওয়ার কোন মানে নেই। রেণুকা সামলাতে পেরেছিল আবিরকে পেয়ে। বয়সে ছোট হলেও দায়িত্বজ্ঞান খুবই টনটনে।  আবীরও বিবাহিত। তবু রেণুকাকে যে পুরুষ একবার দেখেছে  সে ভুলে যায় নিজের অতীত বর্তমানের কথা। শুধু রেণুকাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ এর স্বপ্ন দেখে তারা। রেণুকা বড্ড্ আবেগী মেয়ে। বড্ড বেশি ভালোবাসায় ঠাসা তার মন। এতটা সহ্য হয় না আবিরের। ডালিমেরও হয়নি সহ্য। এতটা সামাল দেয়ার ক্ষমতা নেই ওদের। ওদের প্রেম যেন শরীরের উপরেই এক প্রলেপের মাখন। সহজেই সাধ মিটে যায়। কিন্তু রেনুকা চায় বাঁচতে, নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে তার। ভালোবেসে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা তাদের কাছ থেকেই তো শেখা। এমনি একজনকে পেলে পুরো জীবনটা সুখে বুঁদ হয়ে থাকা যেত। ইচ্ছে করে ফোন বন্ধ করে রাখে আবীর। মিথ্যে করে বলে দেশের বাইরে ছিলাম। এরপর খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছিল রিপন। কেমন করে যেন কথায় কথায় ভাসা ভাসা প্রেম। এরমধ্যেই একদিন দেখা। আর ওই একদিনেই রেণুকা গলে যায়। এরপর আর রিপনের খবর থাকে না। একই সাথে আবির্ভূত হয়েছিল স্বপন। যাকে সে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কেমন করে অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে স্বামী সংসার ডালিম আবির রিপন সবাইকে পেছনে ফেলে স্বপন এসে রেণুকার জীবনটাই পালটে দিল। এত সুখ কল্পনাকেও হার মানায়। স্বপন বলত, তোমাকে পাব বলেই হয়তো এতদিন বিয়েটা করিনি। স্বপন রেণুকার থেকে চার বছরের ছোট। কিন্তু প্রেমে সবার থেকে ছাড়িয়ে। রেণুকার বিস্ময়ের শেষ নেই। কেমন করে একটা পুরুষ একটা নারীকে এত ভালোবাসতে পারে। সব ভুলে মজে যায় এই শেষের স্বপনের দিকে। জীবনের সমস্ত ভাল কিছু উৎসর্গ করে তাকে। ভালোবাসার মর্ম যেন এখানে এসে সে বুঝতে পারে। চারটি বছরের মধ্যে একটি দিনও স্বপন কে ভালো না বেসে থাকেনি সে।  সময় আসে স্বপনেরও। রেণুকা বড্ড বেশি চায়। কাছে থাকলেও যেন মন ভরে না, ওর অতি ভালোবাসা কখনো কখনো অত্যাচারের মত মনে হয় স্বপনের কাছে। সকলেই মানে- রেণুকা হল সেই নারী, যাকে পেলে জীবন ধন্য হয়, আর একটা নারীর কাছ থেকে একজন পুরুষ যা কিছু চায় সেই সবকিছুতেই সে ভরপুর। রেণুকার এই আবেগভরা ভালোবাসাই স্বপনের কাছে আবার অসহিষ্ণু মনে হতে লাগে ধীরে ধীরে । স্বপন বলে, তোমাকে কোনদিনই আমি ছাড়তে পারব না, কিন্তু বিয়ে তোমাকে করা সম্ভব না। বয়সে বড়, অন্যের স্ত্রীকে বিয়ে করলে সমাজে বাস করব কীভাবে।  রেণুকা বলে, কিন্তু এসব জেনেই তো এসেছিলে আমার কাছে। এতকিছুর  রে আজ কেন এ কথা?

পরিবার ও সমাজের বাইরে রেণুকার সাথে  প্রেম করা সম্ভব, কিন্তু স্বীকৃতি দেয়া কিছুতেই না। ততদিনে রেণুকা কাওসারের সংসার ত্যাগ করেছে। তার কথা আর মনে করতে চায় না সে। এখনও মনে পড়লে আঁতকে ওঠে- রোজ রাতে জোর করে শরীরের উপর উঠে পড়া, তারপর বারবার অপারগতার অত্যাচার। না দিতে চাইলে চড় থাপ্পড়, গালিগালাজ। প্রথম প্রেমের সুখ মানুষ ভুলতে না পারলেও রেণুকার কাছে ডালিম মানেই একরাশ কষ্ট আর অপমান। শেষের দিকে বড়ই অমানুষ হয়ে উঠেছিল ডালিম। একইভাবে আবীরও। স্বার্থের তরে মিথ্যার ফুল ঝুড়ি।  আর রিপনের তো কখনো পাত্তাই পাওয়া যায়নি। এড়িয়ে চলে স্বপন। কিন্তু মিলনটাকে এড়াতে পারে না। ফিরে আসে বারবার। আবার বেজে ওঠে বিচ্ছেদের বাঁশি। আশ্বাস দিয়ে বলে, বিয়ে আমি যাকেই করি তুমিই আমার প্রথম বউ। তোমার কাছে আসতেই হবে আমার। অনেক বছর পরে ফিরে আসতে চায় ডালিম, আবির ক্ষমা চায়, আর স্বপন? যার কথা ভেবে রেণুকার কেবলই দীর্ঘশ্বাস! কিন্তু কারো জন্যই আর হৃদয়ের পরতে ভালোবাসার ডালি সাজায় না রেনুকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *