ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট বাংলাদেশ পাচ্ছে কম, দিচ্ছে বেশি

Slider সারাবিশ্ব

bd_india_sm_704405072

 

 

 

 

ট্রানজিটে বাংলাদেশ পাচ্ছে কম, দিচ্ছে বেশি। ট্রানজিটে সবচেয়ে লাভবান হবে ভারত, আর সামান্য আয় হবে বাংলাদেশের। ট্রানজিটের জন্য অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয়ও বেশি করতে হবে বাংলাদেশকে।
চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সড়কপথে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে ত্রিপুরার আগরতলায় পণ্যের একটি চালান গেছে। এটি ছিল সড়কপথের পরীক্ষামূলক ট্রানজিট। বাংলাদেশ এই সুযোগ না দিলে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি, আসাম, মেঘালয়, করিমগঞ্জ হয়ে আগরতলায় যেতে সড়কপথে পাড়ি দিতে হতো ১ হাজার ৫৬০ কিলোমিটার পথ। আর এ জন্য সময় লাগে আট দিন বা ১৯২ ঘণ্টা। কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা পথে যেতে সেই দূরত্ব এক হাজার কিলোমিটার কমে হয়েছে ৫৫৯ কিলোমিটার। চালানটি গেছে মাত্র ৫১ ঘণ্টায়। পরীক্ষামূলক বলেই ভারত এ জন্য প্রতীকী মাশুল দিয়েছে এক টাকা।
সড়কপথে ট্রানজিট মাশুল কত হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। গত সোমবার দিল্লিতে নৌ-ট্রানজিটের মাশুল চূড়ান্ত হয়েছে মাত্র ১৯২ টাকা ২২ পয়সা। এর মধ্যে শুল্ক বিভাগের জন্য ১৩০ টাকা, প্রতি কিলোমিটার সড়ক পরিবহনে ১ টাকা ২ পয়সা ও নৌবন্দর সুবিধায় ১০ টাকা রয়েছে। শিগগিরই বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও ভারতের মধ্যে যান চলাচল চুক্তির আওতায় মাশুল নির্ধারণ করা হবে, যা সড়কপথে ট্রানজিট হিসেবে পরিচিত। সেখানে নৌ-প্রটোকলের সড়ক অংশের ট্রানজিট মাশুলকেই ভিত্তি ধরা হতে পারে।
সুতরাং বলা যায়, এর মাধ্যমে ট্রানজিট মাশুল কত হবে, তার একটি ভিত্তি তৈরি হলো। এর মানে, সড়কপথের ট্রানজিট মাশুলও খুব বেশি হচ্ছে না। এই যে ভারতের এক হাজার কিলোমিটার পথ এবং ১৫০ ঘণ্টা সাশ্রয় হলো, এর একটি অংশ অবশ্যই বাংলাদেশের প্রাপ্য। বাংলাদেশ কি তা আদায় করতে পারবে? আরও প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতি টনে মাত্র ১৯২ টাকা ২২ পয়সা মাশুল পাওয়া গেলে সেটা কি বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট? বিশেষজ্ঞরা কিন্তু তা মনে করছেন না। তাঁরা বলছেন, এই ট্রানজিট মাশুল পর্যাপ্ত নয়। অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ উঠে আসবে কি না, সেই হিসাব না করেই এই মাশুল ঠিক করা হয়েছে। আবার কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে, তা নিয়েও অস্পষ্টতা রয়েছে।
নির্ধারণ করা মাশুল কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক মোহাম্মদ ইউনুস। তিনি ট্রানজিট নিয়ে গবেষণা করেন। প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি টন পণ্যের জন্য মাশুল ১৯২ টাকা খুবই কম। বাংলাদেশের সীমান্তে ঢোকার পরই শুল্ক বিভাগকে পণ্যটি বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করবে না, এমন নিরাপত্তার জন্য ‘সিল’ করতে হবে। এর জন্য বাড়তি অবকাঠামো ও লোকবল লাগবে। আবার বাংলাদেশের ভূখণ্ড পার হয়ে যাওয়ার সময় নিশ্চিত হতে হবে যে এ পণ্য বাংলাদেশের কোথাও নামেনি। তাই আবারও বাড়তি লোকবল ও অবকাঠামো লাগবে। এ জন্য সরকারের বাড়তি খরচ হবে। আবার বছর বছর নৌপথ খননে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। পণ্য ওঠানামার জন্য নৌবন্দরের অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এ অর্থ ভারতের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না।
আবার চার দেশের যান চলাচলের যে চুক্তি করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে প্রতিটি দেশ নিজেদের অবকাঠামো নিজেরাই তৈরি করবে। তাই সড়কপথের অবকাঠামো তৈরি করতে পারস্পরিক আর্থিক সহায়তা পাওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং বিনিয়োগ করতে হবে বাংলাদেশকেই। যদিও ট্রানজিট ব্যবহার করবে সবচেয়ে বেশি ভারত।
অথচ ট্রানজিট নিয়ে সরকার ২০১১ সালে একটি কোর কমিটি গঠন করেছিল। ট্যারিফ কমিশনের সেই সময়ের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ছিলেন কমিটির প্রধান। বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞরাও সেই কমিটিতে ছিলেন। কমিটি একটি সমন্বিত ট্রানজিটের জন্য ১৫ ধরনের মাশুল আরোপের সুপারিশ করেছিল। কমিটির অন্যতম সুপারিশ ছিল, কেবল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক বিভাগের মাশুলই হবে সর্বনিম্ন ৫৮০ টাকা। কোর কমিটি আরও বলেছিল, ট্রানজিট দিতে বাংলাদেশকে যে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, তাতে বিনিয়োগই করতে হবে ৪৭ হাজার কোটি টাকা।
সেই কোর কমিটি নেই। বিনিয়োগ উঠিয়ে আনা নিয়েও কোনো আলোচনা নেই। কোর কমিটির সেই প্রতিবেদনও এখন হিমঘরে। আর ৫৮০ টাকার মাশুল কমতে কমতে হয়ে গেছে ১৩০ টাকা। তবে সংশ্লিষ্ট একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশ যে কম হলেও মাশুল আদায় করতে পারছে, এটাই বড় সাফল্য। কারণ, একসময় সরকারের কেউ কেউ বলেছিলেন, কোনো মাশুলই আরোপ করা যাবে না।
ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ট্রানজিট-সংক্রান্ত সরকার গঠিত কোর কমিটির প্রধান মজিবুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কি খারাপ সড়ক দিয়ে ট্রানজিট দেব? আবার খারাপ সড়ক দিয়ে ট্রানজিট দিলে এটা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশের যানবাহন চলাচলে অসুবিধা হবে। নাকি ভালো সড়ক তৈরি করে ট্রানজিট দেব? সে জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে, তা মাশুল আদায় করে উঠে আসবে কি না—এসব বিষয় বিশ্লেষণ, হিসাবনিকাশ করেই বিনিয়োগ করতে হবে। এটি একটি আপেক্ষিক বিষয়। তাই মাশুল আরোপের আগেই এসব বিষয় চিন্তা করা উচিত ছিল।’
ট্রানজিট একটি অর্থনৈতিক বিষয়। সুতরাং এটিকে বিবেচনা করতে হবে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির নিরিখেই। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনা বেশি প্রাধান্য পেলে প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে পুরো দেশই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *