এক প্রকাশককে হত্যা এবং অন্য তিন লেখক-প্রকাশকের ওপর হামলার ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিশিষ্টজনেরাও জানিয়েছেন প্রতিক্রিয়া। বিশিষ্ট লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজ চিন্তক ফরহাদ মজহার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, দীপন আমাকে এক হিসাবে জোর করেই ‘ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ’ বইটি তৈরি করিয়ে নিয়েছিল। বলেছিল, আপনার কিছু বই আমাকে দিতেই হবে। ও ছিল আহমদ ছফা ও আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন আবুল কাশেম ফজলুল হকের ছেলে। দীপনের চেহারা আমাদের মতো বাম রাজনীতি করে আসা পুরানা আর রুক্ষ বাবা-কাকাদের মতো ছিল না। স্নেহ জাগানিয়া মুখ, লজ্জিত ভাবে হাসত। দুই একবার যতোটুকু কথা বলেছি মনে হয় নি মগজ কোন খোপে বন্ধক দিয়ে দীপন মুক্তবুদ্ধিওয়ালা হয়ে গিয়েছে। চিন্তা করতে চাইত সব দিক থেকেই। ওকে প্রথম দিন থেকেই আমার ভাল লেগেছিল। বইটি ২০১১ সালের শেষের দিকে তৈরি করে দিয়েছিলাম। ও পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে বের করেছিল।
জাক দেরিদার ওপর আমার লেখাগুলো জোগাড় করে বললো এটা গুছিয়ে দিন, আমি প্রচ্ছদ বানিয়ে প্রচার করে দিয়েছি। আমার মাথায় তখন ‘ভাবান্দোলন’ চেপে বসা। দেরিদার সঙ্গে হুসালের তর্ক পাশ্চাত্য চিন্তার জায়গা থেকে যতোটা বুদ্ধিদীপ্ত তার চেয়েও বাংলার ভাবচর্চার জায়গা থেকে আরও দুর্দান্ত। ভাবলাম, নতুন করে পুরাটা বাংলাভাষার ভাবচর্চার ক্ষেত্র থেকে লিখব। এমন ভাবে লিখব যাতে ফকির লালন শাহের ভাষা ও শরীরের সম্পর্ক বিচার কিম্বা নদিয়ার সাধকদের ‘গুরু’ ধারণা ভাষার বহু অর্থ বোধকতাকে কিভাবে মোকাবিলা করে তা নিয়ে লিখি। এতে দেরিদা প্রাসঙ্গিক হবে। বিদেশী দার্শনিকদের নিয়ে আঁতেলি ভাল লাগে না। কিন্তু লেখা সহজে এগুলো না। কারণ যা লিখতে চাই তা সহজ বিষয় নয়। লিখছিলাম আস্তে আস্তে দীপনকে আর দেওয়া হোল না। ও বইয়ের জন্য তাড়া দিতে আবার যখন গত বছর এলো, আমি বুঝিয়ে বলায় খুব খুশি। এ বছর তাকে যেভাবেই হোক শেষ করব বলে কথা দিয়েছিলাম। গুছিয়ে এনেছি।
কিন্তু ফয়সাল আরেফিন দীপন আর নাই।
গতকাল সন্ধ্যায় জাগৃতি প্রকাশনার দীপন সহ শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ টুটুল ও অন্য দুই লেখক সুদীপ কুমার বর্মন ও তারেক রহিমের খবর পেয়ে পাথর হয়ে আছি। দীপনের বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘আমি কোনো বিচার চাই না। আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন উভয় পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন। উভয় পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। এটুকুই আমার কামনা। জেল-ফাঁসি দিয়ে কী হবে।’
অবিশ্বাস্য শোক মাথায় নিয়ে আবুল কাশেম ফজলুল হক এই কথাটা স্পষ্ট ভাবে বলতে পেরেছেন।
আমরা দেশকে বিভক্ত করে দিয়েছি। আমরা দুই পক্ষেই আমাদের সন্তানদের হারাতে থাকব। আমরা কাঁদতে ভুলে যাব। নিজ নিজ সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে গোরস্থানের দিকে যাব, আর সন্তানের রক্তে আমাদের শরীর ভিজে যাবে।
কে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সেকুলার মুক্তবুদ্ধিওয়ালা আর কে ধর্মান্ধ বা ইসলামি জঙ্গী গোরস্থান তার বিচার করে না। শুধু কবরের ওপর ঘাস গজায়, আর একদা ঐতিহাসিকরা গবেষণা করতে বসে কিভাবে একটি জাতি তাদের বেয়াকুবির জন্য ধ্বংস হয়ে গেলো।
যেহেতু আমরা মৃত্যু নিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত নই, তাই জীবনের কোন মূল্য আমরা দিতে জানি না। আমি দেখছি, বিভক্ত ও দ্বিখন্ডিত বাংলাদেশে দুই দিক থেকে দুটো মিছিল গোরস্থানের দিকে যাচ্ছে। দীপন, আমি প্রাণপণ এই বিভক্তি ঠেকাতে চেষ্টা করেছি। এই ভয়াবহ বিভাজনের পরিণতি সম্পর্কে আমি জানপরান সবাইকে হুঁশিয়ার করার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করে যাব।। কিন্তু তাতে কি যারা চলে গিয়েছে ফিরে আসবে?
কেউই প্রত্যাবর্তন করে না।
এই লাশের ভার অনেক ভারি, বাংলাদেশ বহন করতে পারবে কি? সেই দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার চর্চা আমরা করি না যা আমাদের গোরস্থানের দিকে নয়, সপ্রতিভ জীবনের দিকে নিয়ে যায়।
কে জাগে?
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন, আজ থেকে তিন দশকেরও বেশি সময় আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক কর্মিদের হামলায় আহত ও রক্তাক্ত হয়ে ছুটে পথ পেরিয়ে যে গৃহকে নিরাপদ আশ্রয় জেনে উঠেছিলাম সেটি আমার শিক্ষক আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যারের বাসা। স্নেহে ও মমতায় জড়িয়ে ধরে স্যার এবং ভাবী আমার মাথা থেকে বেরুনো রক্তের ধারাকে তোয়াল দিয়ে বেধে দিয়েছিলেন, নিশ্চিত করেছিলেন যেন আমি মেডিক্যাল হাসপাতালে পৌছুতে পারি। আজ সেই নিরাপদ গৃহের সন্তান, ফয়সাল আরেফিন দীপন যখন কর্মস্থলে রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়েছিলো তাকে কেউ জড়িয়ে ধরেনি, কেউ তার রক্তের ধারা তোয়ালে দিয়ে বেধে দেয় নি। হাজার মাইল দূরে বসে আমি কেবল সংবাদ শুনেছি, আমার এই অসহায়ত্বের ভার আমার একার। কিন্ত আমরা যে সেই দেশ তৈরি করতে পারলাম না যেখানে দীপনরা, অভিজিৎরা, সাধারন মানুষেরা নিরাপদ জীবন যাপন করে, যেন মানুষ নির্ভয়ে মত প্রকাশ করতে পারে, ভিন্নমত প্রকাশ যেন নিজের মৃত্যুপরোয়ানার স্বাক্ষরচিহ্ন না হয়, যেন মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পায় তা আমরা কবে বুঝতে পারবো? শোকাহত পিতা আজ তার সন্তান হত্যার বিচার চান নি; শুভবুদ্ধির উদয়ের প্রত্যাশা করেছেন মাত্র। ‘পিতা সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পায়’ বলে কবি নবারুন ভট্টাচার্য যে সময়ের কথা বলেছিলেন তা থেকে এই বক্তব্য কতদূর? একজন নির্ভিক মানুষ, একজন শিক্ষক আজ তার সন্তানের মৃত্যুতে কী বলছেন আমার কি তা শুনতে পাচ্ছি?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার যৌক্তিকতা হিসেবে যে বক্তব্য সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচারিত তা হলো যদি এই সরকার ক্ষমতায় না থাকে দেশ ‘জঙ্গী সন্ত্রাসীরা’ দখল করে নেবে, সাম্প্রদায়িকতা বাড়বে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বিরোধী তৎপরতা বাড়বে। এই যুক্তিতে সরকার গণতান্ত্রিক অধিকারের অনেক কিছু নিশ্চিন্তে সংকুচিত করেছে, অনেক লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবী বহু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও মুখ বন্ধ রেখেছেন পাছে এই সরকারের ক্ষতি হয়। একের পর এক যখন সন্ত্রাসী হুমকি হামলা, লেখক প্রকাশক খুন, সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, ধর্মান্ধতা, জাতিগত ধর্মীয় বিদ্বেষ, দখল লুন্ঠন ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা বেড়েই যাচ্ছে তখন কি এই প্রশ্ন করতে পারি দেশে এখন কোন্ সরকার ক্ষমতায় আছে?