উপরি টাকায় সব ‘ম্যানেজের’ কারখানা হয়ে উঠেছে কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। এ অফিসে কোনো ফাইলই যেন নড়ে না ঘুষ ছাড়া। এটি সীমাহীন ভোগান্তি ও দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে সেখানে সেবা নিতে যাওয়া গ্রাহকদের কাছে। এসব বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত অফিসটির সহকারী পরিচালক আইরিন পারভিন ডালিয়া। এমনকি অফিস ভবনের তৃতীয় তলাতেই তিনি সংসার পেতেছেন বলে জানা গেছে।
উপরি টাকা পেলেই ‘ম্যানেজড’ হন অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে সহকারী পরিচালক পর্যন্ত সবাই। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সেবা নিতে গ্রাহকদের নিয়মিতই গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। সেখানের পিয়ন থেকে শুরু করে সহকারী পরিচালক, সবাই জড়িত দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না সেখানে। এতে করে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন পাসপোর্ট করতে আসা মানুষরা।
অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় বেহাল দশা জেলার এই আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের। পুরাতন কার্যালয় থেকে নতুন কার্যালয়ে স্থানান্তরিত হলেও বিন্দুমাত্র ভোগান্তি কমেনি সেবাগ্রহীতাদের।
অফিসের সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে জিম্মি জেলাটির পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা। পিয়ন থেকে শুরু করে প্রধান কর্মকর্তা পর্যন্ত সবাইকে নানা অজুহাতে দিতে হয় ঘুষ। না দিলে পোহাতে হয় অন্তহীন ভোগান্তি। এর জন্য আবার ব্যবহার করা হয় স্থানীয় দালালদের। সবমিলে কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এখন ঘুষ-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পাসপোর্ট করতে গেলে বিভিন্নভাবে টাকা চেয়ে বসেন অফিসের কর্মকর্তারা। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনসহ নানা জায়গায় অভিযোগ করেও মিলছে না কোনো প্রতিকার। সবাই যেন ‘ম্যানেজড’।
জানা গেছে, ভাড়া বাড়ি থেকে সরে শহরতলীর কাটাবাড়িয়া এলাকায় স্থায়ীভাবে বড় পরিসরে নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। সেখানে পাসপোর্ট করতে গিয়ে রীতিমতো ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সবাইকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফুটতেই পাসপোর্ট অফিসের সামনে দেখা মেলে লম্বা লাইন। বেলা বাড়লেও সেই লম্বা লাইন আর কমে না। আবেদনপত্র জমা, বায়োমেট্রিক বা পাসপোর্ট সংগ্রহ যাই হোক না কেন, বাড়তি টাকা না দিলে সারাদিনই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় লাইনে। কপাল ভালো থাকলে কোনোভাবে জমা দিলেও বাকি কাজটা টাকা ছাড়া শেষ হয় না। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা প্রায়ই বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন অফিস কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে।
শুধু তাই নয়, এ অফিসে দালালের দৌরাত্ম্যও অকল্পনীয়। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কাজ সারেন তারা।
পাসপোর্ট করতে আসা একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ, দালালদের মাধ্যমে আবেদন ফরম জমা দিলে তা অনেক সহজেই জমা পড়ে। দালালরা দ্বিগুণ টাকার বিনিময়ে সহজেই পাসপোর্ট করে দিতে পারেন। আর তাদের আশ্রয় না নিলে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের থেকে হয়রানির শিকার হতে হয়। তারা পাসপোর্ট ফরমে বিশেষ কলমের চিহ্ন ব্যবহার করেন। সাধারণ মানুষের সেই চিহ্ন বুঝার কোন উপায় নেই। এছাড়াও সেখানে কর্মরত কিছু আনসার ও পুলিশ সদস্য দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। তাদের মাধ্যমেই পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাড়তি টাকার ভাগ পান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাসপোর্ট ফরমে সবকিছু ঠিক থাকার পরও কর্মকর্তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পুনরায় ফরম পূরণ করে জমা দিতে বলেন। পরে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা এমন পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে নিজেরা ফরমটি ঠিক করে দেবেন বলে জানান। এসব কাজে স্থানীয় দালালদের লাগানো হয়। সবশেষ চ্যানেলের মাধ্যমে না গেলে আবেদন ফাইল স্বাক্ষর হয় না। ফলে পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা বাধ্য হন দালাল ও চ্যানেল ধরতে।
শুধু পাসপোর্টই নয়, জালিয়াতি করে জাতীয় পরিচয়পত্রের সংশোধনী ও বয়স বাড়ানোর কাজটি করেন দালালরা। বয়স কম থাকলেও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তা বাড়িয়ে দিয়ে পাসপোর্ট করা যায়। এর জন্য গুনতে হয় ৮ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
পাসপোর্ট করতে আসা একজনের কাছ থেকে অফিসের আনসার সদস্য ইকরাম তিন হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার গোপন ভিডিও ও মোবাইল ফোনে কথোপকথনের প্রমাণ আসে সাংবাদিকদের হাতে। পরে বিষয়টি তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, সব টাকা তিনি পায় না। অন্যান্যদেরও দিতে হয়। স্যার-ম্যাডামকে দেওয়ার পরে সামান্য কিছু টাকা তার কাছে থাকে।
সবচেয়ে বেশি অনিয়মের অভিযোগ আছে পাসপোর্ট অফিসটির সহকারী পরিচালক আইরিন পারভিন ডালিয়ার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সোমবার (০৭ অক্টোবর) তার বক্তব্য নিতে যাওয়া হয়। এদিন বেলা ১২টার দিকে গিয়ে তার রুম বন্ধ পাওয়া যায়। দায়িত্বরত অফিস সহকারীর কাছে তার খোঁজ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম ভবনটির তৃতীয় তলায় বাসায় আছেন।’
তিনি কখন আসবেন জানতে চাইলে ওই কর্মচারী সহকারী পরিচালককে ফোন দিয়ে বলেন যে সাংবাদিকরা এসেছেন। উত্তরে তিনি জানতে চান সাংবাদিকরা কেন এসেছেন। তার একটি বক্তব্য নেওয়ার কথা জানানো হয় তাকে। পরে তিনি সাংবাদিকদের অপেক্ষা করতে বলেন। প্রায় ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে এদিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে অফিস কক্ষে আসেন এই কর্মকর্তা।
উনার অফিসের আনসার সদস্যরা টাকা নিয়ে কাজ করার বিষয়ে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকের কাছে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। উলটো অফিসের স্টাফদের দিয়ে সাংবাদিকদের বের হয়ে যেতে বলেন। একপর্যায়ে বায়োমেট্রিক রুম থেকে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হেদায়েতুল্লাহ ডেকে এনে বক্তব্য নিতে যাওয়া উপস্থিত সাংবাদিকদের ভিডিও করে রাখেন তিনি।
এছাড়াও সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, গোপন ভিডিওসহ সব তথ্য না দেখালে উনি কোনো বক্তব্যই দেবেন না। যা মন চায় তাই করতে বলেন সাংবাদিকদের।
উল্লেখ্য, কিশোরগঞ্জের সবকটি উপজেলার মানুষ পাসপোর্ট করতে এখানে আসেন। এর মধ্যে ভৈরব, কুলিয়ারচর, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর,কটিয়াদী তাড়াইল-এই উপজেলাগুলোর দূরত্ব প্রায় ২৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার। এ অফিসে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ বা তারও বেশি আবেদন জমা হয়। পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের অভিযোগ দালাল ছাড়া আবেদন জমা দিলে বিভিন্ন রকমের হয়রানির শিকার হতে হয়।