মাঠে নামে ছাত্রলীগ করা কর্তারা, শেষ সময়ে নিয়ন্ত্রণে ছিল না পুলিশ

Slider বাংলার আদালত

চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নেবে— এমন গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার পরই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক(আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। সেসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎও করেন তিনি। এরপরই পুলিশকে শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়।

গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে রিমান্ডে রয়েছেন সাবেক এই আইজিপি। সেখানেই জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত কর্মকর্তাদের এসব কথা জানিয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন।

তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় পরিস্থিতি বুঝে কঠোরতা প্রদর্শনের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর মাঠে সক্রিয় হওয়ার জন্য বলা হয়, বিশেষ করে ছাত্রলীগ করে আসা পুলিশ কর্মকর্তাদের। এরপর পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কঠোরতা প্রদর্শনের নির্দেশ দেওয়া হলে নির্বিচারে ছাত্র-জনতার ওপর গুলির ঘটনা ঘটে, যা গণহত্যায় রূপ নেয়। পরে আর মাঠ পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।

তদন্তকারী একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রেপ্তারের পর থেকে জিজ্ঞাসাবাদে নির্বাক রয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। কোনোভাবেই গণহত্যার দায় এড়াতে পারেননি। তবে তিনি দাবি করেছেন— ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে মাঠ পুলিশ তার কমান্ড বা নিয়ন্ত্রণে ছিল না। রাজনৈতিক বিবেচনায় ভূমিকা নেয় মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা, বিশেষ করে ডিএমপি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের(ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার(ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি, দমন-পীড়ন সম্পর্কে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি আন্দোলন সংক্রান্ত অনেক বিষয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে। মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। রিমান্ড শেষে প্রাপ্ত তথ্য আদালতকে জানানো হবে। তাদের আরও অনেক বিষয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হতে পারে। গ্রেপ্তার হতে পারেন নতুন মামলায়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছাত্রদের হাতে শুরু হওয়া আন্দোলন দমন-পীড়নের কারণে গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। এই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গণহত্যায় তৎকালীন সরকারের চাপ আর সরকার দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ন্যায় পুলিশকে ব্যবহার করা হিতে বিপরীত হয়েছে। আজ পুলিশের ভূমিকা ও ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে ছাত্র-জনতার রোষ পড়ে পুলিশের ওপর। এই দায় তো তৎকালীন পুলিশ প্রধান হিসেবে মামুন স্যার এড়াতে পারেন না।

তিনি বলেন, ‘আমরা তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তিনি দায় এড়াতে চেষ্টা করেননি। বেশিরভাগ সময় নির্বাক ছিলেন, কখনো প্রশ্ন শুনে হতভম্ব হয়ে পড়েন তিনি।’

এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও জানান, আন্দোলন দমনের নামে গণহত্যা চালানোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা হয়েছিল কিনা, শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে কী ধরনের চাপ ছিল, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। এসব প্রশ্ন শোনে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন সাবেক আইজিপি মামুন স্যার। তিনি বলেন— আন্দোলন দমনের চাপ ছিল, নির্দেশনাও ছিল। কিন্তু শেষের দিকে আন্দোলন যেমন নিয়ন্ত্রণে ছিল না তেমনি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আইজিপি হতে চাননি মামুন

জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে বিমর্ষ হয়ে পড়েন সাবেক আইজিপি মামুন। তিনি বলেন, দ্বিতীয় দফায় চুক্তিভিত্তিক আইজিপি হতে ইচ্ছে ছিল না। এতে করে বাহিনীতে চেইন অব কমান্ডে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। কাউকে বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা এড়াতে পারিনি। সেদিন যদি নারাজি দিতাম তাহলে হয়তো আমি এই গণহত্যার দায়মুক্ত থাকতাম।

যদিও নিজে থেকে কাউকে বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত না থাকার ব্যাপারে সাফাই গান তিনি।

গত ৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে পৃথক হত্যা মামলায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও এ কে এম শহীদুল হককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ(ডিবি)। ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সেনা হেফাজতে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তিনি সেনা হেফাজতে থাকা অবস্থায় আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রাতে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়।

পরদিন ৪ সেপ্টেম্বর(বুধবার) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পৃথক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিন করে রিমান্ড অনুমতি চেয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মুদি দোকানি আবু সায়েদ হত্যা মামলায় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এ আদেশ দেন।

আবু সায়েদ হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ মামলায় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা শক্ত হাতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মামলার আরেক আসামি ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন। মামলার ৩ নম্বর আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ অন্যরা ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মামলার ৫ নম্বর আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান পুলিশকে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করার নির্দেশ দেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *