কমপ্লিট শাটডাউনে’ দেশজুড়ে ব্যাপক সংঘর্ষ, হতাহত অনেক

Slider সারাদেশ


কোটার যৌক্তিক সংস্কার এবং শিক্ষার্থী হত্যার বিচার দাবিতে আজ সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সকাল থেকে শুরু হওয়া এ কর্মসূচি চলাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান আন্দোলনকারীরা। চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা। এসব

ঢাকা : কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির অংশ হিসেবে উত্তরা-আজমপুর এলাকায় ছাত্ররা সড়ক অবরোধ করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের গুলিতে ও গাড়িচাপায় শিক্ষার্থী-পথচারীসহ চারজন নিহত হন। তাদের মরদেহ কুয়েতমৈত্রী হাসপাতালে রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে হাসপাতালটিতে আহত হয়ে আরও শতাধিক ব্যক্তি চিকিৎসা নিতে এসেছেন।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বিকেলে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট মিজানুর রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, আহত হয়ে শতাধিক মানুষ আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তাদের মধ্যে চারজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।

এদিকে আজমপুর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, সংঘর্ষে প্রায় ২০০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানে গেছেন এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে। আহতদের মধ্যে যারা গুরুতর, তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এর আগে উত্তরায় পুলিশ ও র‍্যাবের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে দুজন নিহতের খবর পাওয়া যায়। তাদের একজন উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান এবং আরেকজন উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে মারা যান। দুই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়া ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষার্থী, সাভারে এক শিক্ষার্থী, রামপুরায় এক পথচারীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

কুমিল্লা : কুমিল্লায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে শিক্ষার্থী, সাংবাদিক এবং পুলিশসহ অন্তত অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়ি বিশ্বরোড এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

দুপুর ১টার দিকে কোটবাড়ি বিশ্বরোড এলাকার পশ্চিম পাশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সহ আন্দোলনরত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পুলিশের দিকে ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দিতে দিতে অগ্রসর হন। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডসহ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে। এতে কয়েকজন সাংবাদিকসহ অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী ও পুলিশ আহত হন।

খুলনা : এক দফা দাবি ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে খুলনার শিববাড়ি মোড় অবরোধ করেছেন বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। অবরোধের কারণে শিববাড়ি মোড়ে খুলনা-যশোর মহাসড়ক, শিববাড়ি থেকে সোনাডাঙ্গা, ময়লাপোতা, রূপসা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শহরের বিভিন্ন স্থানে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। শিববাড়ি মোড়ে পুলিশের সাঁজোয়া যান রয়েছে।

পাবনা : পাবনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এতে পুলিশসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আটক করা হয়েছে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বিকেল ৩টার দিকে পাবনা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (সাড়ে ৩টা) বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চলছে। আহতদের তাৎক্ষণিক নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি।

লালমনিরহাট : লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করেছেন শিক্ষার্থীরা।

হাতীবান্ধা উপজেলা সদরে গণজমায়েত হন শিক্ষার্থীরা। এ সময় দুই শিক্ষার্থীকে একা পেয়ে মারপিট করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মেডিকেল মোড় থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় পর্যন্ত লালমনিরহাট বুড়িমারী মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে কিছু শিক্ষার্থী দলীয় কার্যালয়কে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোড়ে এবং কিছু ব্যানার বিলবোর্ড ভেঙে ফেলে। ইট ও পাটকেলের ঢিলে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের জানালার গ্লাস ভেঙে যায়।

জয়পুরহাট : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় শিক্ষার্থী ও পুলিশের অন্তত ১৭ জন আহত হয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহরের জিরো পয়েন্ট এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত থেমে থেমে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। এ সময় জেলার প্রধান সড়কে সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।

ছাত্ররা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের দিকে যেতে চাইলে সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের একটি ভ্যান তাদের ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে। এ সময় ছাত্র আন্দোলনের কিছু শিক্ষার্থী রেলগেটে গিয়ে পাথর নিয়ে ছুড়তে থাকে। সেখানেই শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।

নাটোর : কোটাবিরোধী শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নাটোর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এতে পুলিশ সুপারসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।

ঘটনার শুরু বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকাল ১০টায়। সকাল থেকে নাটোর শহরের প্রেসক্লাব চত্বরে জড়ো হতে থাকেন কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও লাঠি ও হকিস্টিক হাতে সেখানে উপস্থিত হয়। পুলিশ উভয়পক্ষকে সংঘর্ষ থেকে নিবৃত্ত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু এক পর্যায়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। সংঘর্ষে পুলিশসহ মোট ২০ জন আহত হন।

টাঙ্গাইল : কোটা সংস্কারের দাবিতে টাঙ্গাইল শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আন্দোলনকারী‌দের ছত্রভঙ্গ কর‌তে পু‌লিশ টিয়ার‌ শেল ও রাবার বু‌লেট ছু‌ড়ছে। এতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। সংঘ‌র্ষে পু‌লিশ সাংবা‌দিকসহ ৩০ জন আহত হ‌য়ে‌ছেন। এই ঘটনায় শহ‌রে থমথম অবস্থা বিরাজ কর‌ছে।

ময়মনসিংহ : শাটডাউন কর্মসূচিতে অচল হয়ে পড়েছে ময়মনসিংহ। বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লার সড়কে সব ধরনের যান চলাচল। একই অবস্থা নগরীর মার্কেটগুলোরও।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ময়মনসিংহ নগরীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র।

নগরীর মাসকান্দা বাস টার্মিনালের এন কাউন্টারের সহকারী ম‍্যানেজার মো. খোরশেদ আলম (৫৫) ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকাল থেকেই দূরপাল্লার সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। যাত্রী, হেলপার ও চালকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে কারো কোনো নির্দেশনা নেই।

মানিকগঞ্জ : কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জেলা শহরে জড়ো হওয়ার সময় খালপাড় এলাকায় আসা মাত্রই ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এ সময় পুলিশ কয়েকটি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০ টার সময় জেলা শহরের খালপাড়া এলাকায় এ ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আন্দোলনকারী বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়।

সকাল সোয়া ১০টার দিকে বাসস্ট্যান্ড থেকে জেলা শহরে মিছিল নিয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। মিছিলটি খালপাড় এলাকায় আসার পরই ছাত্রলীগের কর্মীরা শিক্ষার্থীর ওপর হামলা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা। শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরাও ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীর লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে মারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েকটি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। প্রায় ৩০ মিনিটের মতো চলে এই সংঘর্ষ।

প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ বক্তব্যকে ঘিরে গত রোববার মধ্যরাত থেকে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের ছাত্রসমাজ। এরপর সোম, মঙ্গল ও বুধবার টানা তিনদিন সারা দেশে ছাত্র আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে।

আন্দোলন দমাতে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগও মাঠে নামে। এতে সোমবার ও মঙ্গলবার সারা দেশে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। মঙ্গলবার একদিনেই ৩ শিক্ষার্থীসহ ৬ জন মারা যান। এদের মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদকে পুলিশ নিরস্ত্র অবস্থায় সামনাসামনি গুলি করে হত্যা করে।

এসব হত্যার ঘটনায় গতকাল বুধবারও আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল ছিল রাজপথ। গতকাল সন্ধ্যায় এ নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেই ভাষণেও সমস্যার কোনো সমাধান দেওয়া হয়নি দাবি করে এবং প্রতিটি হত্যার বিচার দাবিতে আন্দোলনকারীরা আজ বৃহস্পতিবার সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *