মাছ চাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় উত্তরবঙ্গের শস্যভাণ্ডার খ্যাত সিরাজগঞ্জে পুকুর কাটার হিড়িক পড়েছে। জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধানের আবাদ হয় তাড়াশে। এই উপজেলায় এক্সকাভেটর দিয়ে তিন ফসলি উর্বর জমি কেটে পুকুর খনন করার ফলে প্রতি বছর আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে বছর শেষে ফসলি জমির পরিমাণ ভয়ংকরভাবে হ্রাস পাবে।এ জেলায় প্রচুর পরিমাণ ধান, গম, খিড়া, শষা, পাট, বেগুন, ডাল, রসুন, কাঁচা মরিচ, আখসহ বিচিত্র রকমের ফসল উৎপাদিত হয়, যার উদ্বৃত্ত অংশ দেশের অন্যত্র বিক্রি হয়। কিন্তু অচিরেই খাদ্যে উদ্বৃত্ত এই জেলায় খাদ্য সংকট দেখা দেবে। এর প্রভাব পড়বে সারা দেশেও। উপজেলা কৃষি বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ৫৩৯ টি পুকুর খনন করা হয়েছে। এ দেড় দশকে ১ হাজার ৯২০ হেক্টর আবাদি জমি কমেছে। শুধু কৃষি জমিই নষ্ট হচ্ছে না, মাটি বহনকারী ডাম ট্রাক ও ট্রাক্টর চলাচলের কারণে সড়ক-মহাসড়কেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জেল-জরিমানা করেও পুকুর খনন বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে ধানের উৎপাদন কমে আসবে। দ্রুত এর অবসান না হলে জলাবদ্ধতাসহ পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখে দেবে।স্থানীয়রা জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে ফসলি জমিতে পুকুর খনন করছেন হাজি বাবু নামে একজন। ভায়াট গ্রামের আলামিন জমি ইজারা নিয়ে পুকুর খনন করছেন। লালুয়া মাঝিড়া গ্রামের উত্তর মাঠে একটি বড় পুকুর খনন করছেন খোকা নামে এক ব্যক্তি। সরকারি অফিসের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ রকম অধিকাংশ গ্রামে রাতের আঁধারে কৃষিজমির এমন ধ্বংসযজ্ঞ চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চললেও কৃষি জমিসহ নদী ও খাস জমি দখল করে চলছে পুকুর খনন।বাঁশবাড়িয়া গ্রামের পুকুর খনন কারী হাজি বাবু ও আলামিন জানান, কয়েক বছর ধরে তাড়াশের বিভিন্ন স্থানে পুকুর খনন করা হচ্ছে। তাই তাঁরাও করছেন। সবারটা বন্ধ হলে তাঁরাও আর খনন করবেন না। কালিদাসনিলি গ্রামের তারিকুল ইসলাম, শাজাহান আলী ও আখতার হোসেন জানান, হাজি বাবু বাঁশবাড়িয়া গ্রামে আবাদযোগ্য জমিতে ৪৫ থেকে ৫০ বিঘা জমিতে একটি পুকুর খনন করছেন। পুকুরটির খনন শেষ হলে উত্তর ও দক্ষিণের মাঠের পানি নামতে পারবে না। তখন জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেবে।ট্রাকের মালিকদের সুত্রে জানা যায়, প্রতিটি গাড়ির মাটি বিক্রি হচ্ছে ৮০০-১০০০ টাকায়। সেই সঙ্গে গাড়িগুলো চালাতে দেখা যায় বেশির ভাগই অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকদের। যাদের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স বা গাড়ি চালানোর কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। এছাড়া একই ইউনিয়নের জহুরুল ইসলাম নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষক বলেন, আমার ১০ কাঠা জমি ছিল। সলঙ্গা থানার কুমার গাইলজানি গ্রামের সাচ্চু নামের একজন মাঠের ১৫ জন কৃষকের জমি ইজারা নিয়েছেন পুকুর খননের জন্য। শেষমেশ আমিও দিতে বাধ্য হই। নয়তো আমার ওইটুকু জমি পুকুরের এক কোনায় পানিতে তলিয়ে থাকত।তাড়াশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা লঙ্ঘন করে পুকুর খনন করার অপরাধে গত ১ মাসে জমির মালিকদের বিরুদ্ধে ২০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে ৮টি, ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ১০টি এবং সাধারণ কৃষকরা বাদী হয়ে ২টি মামলা করেছে।তাড়াশ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খালিদ হাসান বলেন, পুকুর খননের তথ্য পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতে বেশ কয়েকজনকে জেল ও জরিমানা করা হয়েছে। সগুনা ইউনিয়নের খরখড়িয়া গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠের আবাদযোগ্য উর্বর জমি কেটে পুকুর খনন করার অপরাধে গত ১ জানুয়ারি এক ব্যক্তিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৩ মাসের জেল দেওয়া হয়েছে। নওগাঁ ইউনিয়নের ভায়াট গ্রামে পুকুর খনন করায় সুমন মোল্লা ও সাদ্দাম হোসেনকে এক মাস করে জেল দেওয়া হয়েছে। পৌষার গ্রামে পুকুর খনন করার অপরাধে শাজাহান নামের এক ব্যক্তিকে ৬ মাসের জেল দেওয়া হয়।উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, তাড়াশের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে বছরে তিন ফসলিসহ বিভিন্ন জাতের ধান ও রবিশস্যের আবাদ হয়। তারপরও কৃষকেরা তাঁদের জমি কেটে পুকুর খনন করছেন। মূলত মধ্যস্বত্বভোগী একটি চক্র কৃষকের সব দায়ভার নিয়ে পুকুর খনন করে দিতে উৎসাহিত করছেন।সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (উপ-পরিচালক) বাবলু কুমার সুত্রধর বলেন, এই জেলার মতো উর্বর এবং তিন থেকে চার ফসলি জমি দেশের খুব কম এলাাকায় আছে। সে কারণে সিরাজগঞ্জ জেলা শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত। ভবিষ্যতে সেই সুনাম ধরে রাখা সম্ভব হবে না। দেড় দশকে ১ হাজার ৯২০ হেক্টর আবাদি জমি কমেছে। তিনি আরও জানান, মানুষ কেন বুঝতে চাচ্ছে না যে আবাদি জমি কমে গেলে তাদের জীবন সংকটাপন্ন হবে। ফসলি জমিতে পুকুর খনন বা শিল্পায়ন কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।#