শান্তিতে নোবেলজয়ী ও গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমি কোনো অপরাধ করিনি, শঙ্কিত কেন হবো?’
দুদক তলব করায় বৃহস্পতিবার সকালে সংস্থাটির কার্যালয়ে হাজির হন তিনি। এসময় তার সাথে ছিলেন আইনজীবীরা।
দুদক কী জানতে চেয়েছে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে আপনারা কষ্ট করে এসেছেন সেজন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
পরে আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
এর আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আইনজীবীসহ দুদক কার্যালয়ে হাজির হন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি স্বভাবসুলভ হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে দুদক কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করেন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে দুদক কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি।
গ্রামীণ টেলিকমের ‘অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের’ অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। শ্রমিকদের লভ্যাংশ আত্মসাতের অভিযোগের ভিত্তিতে কলকারখানা পরিদফদর থেকে তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে দুদক মামলা দায়ের করেছিল।
ড. ইউনূস যা বললেন
দুদক কার্যালয় থেকে বের হয়ে আসার সময় অধ্যাপক ইউনূস এবং তার আইনজীবীকে ঘিরে ধরেন সাংবাদিকরা।
প্রথমে অধ্যাপক ইউনূসের আইনজীবী মামলার বিষয়বস্তু এবং দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্য তুলে ধরেন।
আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই অধ্যাপক ইউনূস দুদকে হাজির হয়েছেন।
এক পর্যায়ে সাংবাদিকরা আইনজীবীকে এড়িয়ে অধ্যাপক ইউনূসের কাছ থেকে বক্তব্য জানতে চান। এ নিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের আইনজীবী এবং সাংবাদিকদের মধ্যে কিছুটা বিতণ্ডা হয়।
এ সময় অধ্যাপক ইউনূস তার আইনজীবীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
অধ্যাপক ইউনূসকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি দুদকের ভয়ে শঙ্কিত কী না? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি তো অপরাধ করি নাই, শঙ্কিত কেন হবো? শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নাই।’
সাংবাদিকদের ক্রমাগত প্রশ্নে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমাকে ডেকেছে, সেজন্য আমি এসেছি। আমার আর কিছু বলার নাই।’
বিষয়টিকে তিনি ‘লিগ্যাল মেটার’ বা আইনগত বিষয় হিসেবে বর্ণনা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন আইনগত বিষয়টি তার আইনজীবী ‘শান্তভাবে বুঝিয়ে’ দেবেন। সাংবাদিকরা অধ্যাপক ইউনূসকে একের পর এক প্রশ্ন অব্যাহত রাখলে তিনি বলেন, ‘আমাকে দিয়ে আর কিছু বলাইয়েন না।’
ড. ইউনূসের আইনজীবীর ব্যাখ্যা
গত ৩০ মে গ্রামীণ টেলিকম থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
দুদকের উপ-পরিচালক মো: গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদি হয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ এনে সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি করেন।
এর আগে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ সংবলিত একটি প্রতিবেদন দুদকে পাঠায়।
ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের কথা জানায় দুদক।
অভিযোগগুলো ছিল অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ অর্থ লোপাট, শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধকালে অবৈধভাবে অ্যাডভোকেট ফি ও অন্যান্য ফির নামে ছয় শতাংশ অর্থ কর্তন, শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলে বরাদ্দ করা সুদসহ ৪৫ কোটি ৫২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৩ টাকা বিতরণ না করে আত্মসাৎ। এছাড়া কোম্পানি থেকে দুই হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ।
ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন দুদক কার্যালয়ের বাইরে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘গ্রামীণ টেলিকম একটি সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যার লক্ষ্য শিল্প কারখানা গড়ে তুলে বেকারত্ব দূর করা এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা। তাতে বলা আছে, কেউ কোনো মুনাফা নেবে না। এই মুনাফা উন্নয়নের জন্য একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য ব্যবহার করা হবে।’
কোম্পানি আইনের ২৮ ধারার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আইনানুযায়ী যারা সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করবে তাদের কোনো মুনাফা দেয়া নিষিদ্ধ। তাই এই গ্রামীণ টেলিকম, কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী একটি সিদ্ধ প্রতিষ্ঠান। এটা লেবার আইনে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি নয়, কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কোম্পানির আইনে।’
গত সপ্তাহে এক চিঠির মাধ্যমে ড. ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানির আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে দুদকে তলব করা হয়।
ড. ইউনূসের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদসহ ১৩ জন আসামির বিরুদ্ধে ২৫ দশমিক ২২ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আপনার বক্তব্য শ্রবণ ও গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।
এজন্য ৫ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১২টায় উপর্যুক্ত বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য দুদক কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তদন্তকার্যে সহযোগিতা করতে আপনাকে অনুরোধ করা হলো।
ড. ইউনূস ছাড়াও অন্য যাদের তলব করা হয়েছে, তারা হলেন গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: নাজমুল ইসলাম, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভিন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম ও এস. এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী।
ট্রেড ইউনিয়ন মামলা দায়েরের পর, ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল গ্রামীণ টেলিকম তাদের কর্মচারীদের পাওনা লভ্যাংশ বিতরণের জন্য গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাথে একটি চুক্তি করে।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, কর্মচারীদের লভ্যাংশ বিতরণের আগেই তাদের প্রাপ্য অর্থ আসামিরা আত্মসাৎ করেছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মো: নাজমুল ইসলামসহ গ্রামীণ টেলিকমের বোর্ডের সদস্যদের উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ৯ মে গ্রামীণ টেলিকমের ১০৮তম বোর্ডের সভায় ঢাকা ব্যাংক লিমিটেডের গুলশান শাখায় একটা ব্যাংক হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু ব্যাংক হিসাবটি খোলা হয় নির্ধারিত তারিখের একদিন আগেই অর্থাৎ ৮ মে এবং সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট দেখিয়ে।
ওই সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্টের শর্ত অনুযায়ী ও বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গ্রামীণ টেলিকম বিভিন্ন সময় ওই ব্যাংক হিসাবে ২৬ কোটি ২২ লাখ ছয় হাজার ৭৮০ টাকা স্থানান্তর করে। এর মধ্যে অ্যাডভোকেট ফি হিসাবে হস্তান্তরিত হয় এক কোটি টাকা।
বাকি ২৫ কোটি ২২ লাখ ছয় হাজার ৭৮০ টাকা গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
এরপর ২০২২ সালের ২৮ জুলাই কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের চার অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
এসব অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ড. ইউনূসের আইনজীবী বলেন, ‘গ্রামীণ টেলিকমের নিজস্ব কোনো কার্যক্রম নাই। গ্রামীণ পল্লী ফোন কার্যক্রম, নোকিয়া হেডসেটের বিক্রয়োত্তর সেবা দিয়ে তারা চলেন তিন বছরের চুক্তি মাধ্যমে। শ্রমিকদেরও তিন বছরের চুক্তি দেয়া হয়। আমাদের পার্মানেন্ট স্ট্রাকচার (স্থায়ী কাঠামো) নাই, তাই তারা শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিল পাওয়ার অধিকারী না।’
তিনি আরো বলেন, ‘মামলার পর বাধ্য হয়ে আমরা শ্রমিকদের সাথে একটি সমঝোতা চুক্তি করে তাদের পাঁচ শতাংশ দেয়ার কথা বললাম। চুক্তিতে সাত দিনের মধ্যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হলো। এই সময়ে কোম্পানির বোর্ড মিটিং ডাকা সম্ভব হয়নি। এই চুক্তি হয়েছে হাইকোর্টের নির্দেশনায়, হাইকোর্টের অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়ে। অর্ডারটি ৯ তারিখ প্রকাশ হবে। তাই বাধ্য হয়ে ৮ তারিখে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয় কোন টাকা জমা দেয়া ছাড়া। এরপর ৯ তারিখ বোর্ডের সাথে ভার্চুয়াল মিটিং করে সব বলা হয়।
সূত্র : বিবিসি