চলমান উদ্বেগ-উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির চূড়ান্ত গন্তব্য কোথায়, তার জবাব মিলতে পারে অক্টোবরেই। রাজনৈতিক সূত্রগুলোর আভাস অনুযায়ী, আগামী মাস হতে পারে রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট। বিরোধী দলগুলোও সরকারের পতনের দাবিতে এই মাসে চূড়ান্তভাবে বেছে নিতে পারে রাজপথ। সমঝোতার কোনো লক্ষণ না থাকায় সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কাও রয়েছে জোরালোভাবে ।
চলমান ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনী ব্যবস্থার আস্থাপূর্ণ সমাধানের দাবি গত ১০ বছর ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচিত ইস্যু। ২০১৩ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়ার পর থেকেই রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহালের দাবিকে ঘিরেই। এই দাবি আদায় না হওয়ায় ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিসহ কমপক্ষে ২৯টি রাজনৈতিক দল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও একই দাবিতে পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত। তত্ত্বাবধায়কবিহীন ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠে দেশে-বিদেশে। এখন আরেকটি জাতীয় নির্বাচন কড়া নাড়ছে। নির্বাচন কমিশন আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার পরিকল্পনা করছে।
জানা গেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হতে পারে। বিরোধী দলগুলো যেমন শক্ত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারে, তেমনি সরকারি দলও পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। সূত্রগুলো বলছে, রাজনীতির বাইরের শক্তিও এই সময়ে আরো ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশ ঘিরে প্রভাবশালী দেশগুলোর অবস্থান প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে আরো বেশি। কারো কারো অনুমান, মার্কিনিরা যেভাবে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ওয়াচে রেখেছে, সেটি আরো জোরালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আগামী দিনগুলোতে।
রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেছেন, আগামী নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখতে সরকারও যথেষ্ট তৎপর রয়েছে। মার্কিনিদের চাপ তারা মোকাবেলার চেষ্টা করছে ঘনিষ্ঠ তিন প্রভাবশালী দেশের সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের মধ্য দিয়ে। সরকার রাজপথের আন্দোলন মোকাবেলা করেই বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর বলেও সূত্রগুলো জোরালোভাবে বলছে। কেউ কেউ বলেছেন, যেকোনো পরিস্থিতির সামাল দিয়ে নির্বাচন করে ফেলতে পারলে, ক্ষমতার ধারাবাহিকতা অটুট রাখাও সম্ভব হবে।
এ দিকে চূড়ান্তভাবে দাবি আদায়ে অক্টোবর মাসকে টার্গেট করেছে বিএনপি। দলটি আগামী মাসে রাজপথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লাগাতার কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দাবি আদায় করতে চায়।এ লক্ষ্যে সাংগঠনিকভাবে যা যা করা দরকার তার সব কিছু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলটির নীতি-নির্ধারকরা। দলটির অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী নভেম্বরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই চলমান এক দফার আন্দোলনকে পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চান তারা।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, এক দফা দাবি আদায়ে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই লাগাতার অলআউট আন্দোলন শুরু হতে পারে। তখন সব কর্মসূচি হবে ঢাকাকেন্দ্রিক এবং তা যুগৎতভাবে পালিত হবে। আর সে সময় কর্মসূচি শুধু শুক্র-শনিবারে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে এই চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনের সূচনা হতে পারে। আর মধ্য অক্টোবর থেকে ঘেরাওয়ের কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে দলটি। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘেরাওয়ের পাশাপাশি টানা অবস্থানের কর্মসূচিতে যেতে পারে বিএনপি। জানা গেছে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে দেশব্যাপী তারুণ্যের রোডমার্চের সঙ্গে এক দফার কর্মসূচিও চালাবে বিএনপি। প্রতি শুক্র ও শনিবার পদযাত্রা, গণমিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি চলতে থাকবে। আগামী শুক্রবার বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলায় অন্যায়ভাবে সাজা দেয়ার প্রতিবাদে ঢাকায় সমাবেশ করবে দলটি। ওই দিন বিকেল ৩টায় নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির যৌথ উদ্যোগে এই প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া চলতি মাসের মধ্যে বিচারালয়ের সামনে আইনজীবীদের অবস্থান কর্মসূচিও হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে সরকার যে বিরোধী দল দমনে আদালতকেও ব্যবহার করছে- দলের এই বক্তব্য সব মহলের কাছে পৌঁছাতে চায় দলটি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এক দফার অলআউট আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনার মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে এক দফার অলআউট আন্দোলনকে সামনে রেখে সারা দেশে দলের সাংগঠনিক অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়। সাংগঠনিক সম্পাদকরা আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে ‘রেডি কমিটি ছাড়া’ দেশের কোথাও নতুন করে দল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কোনো কমিটি না দেয়ার পরামর্শ দেন। তাদের দাবি, নতুন করে কমিটি দেয়া হলে সংগঠনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, যোগ্য সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে আংশিক কমিটি দেয়া সম্ভব হয় না। যার নেতিবাচক প্রভাব আন্দোলনে পড়তে পারে। এ ছাড়া এক দফা আন্দোলনের আগামীর কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতা দূরীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন সাংগঠনিক সম্পাদকরা। কর্মসূচি সফলে যেকোনো ধরনের সমন্বয়হীনতা নিরসনে বিএনপি মহাসচিবকে দলের সব স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন তারা, যাতে করে কর্মসূচি সম্পর্কে অবগত নয়- এমন অভিযোগ কেউ করতে না পারে।
এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর হাইকমান্ডের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও যুগ্ম-মহাসচিবরাও আগামীর কর্মসূচি সফলে যেকোনো মূল্যে সমন্বয়হীনতা নিরসনের ওপর জোর দেন। তারা তফসিলের আগেই আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার পরামর্শ দেন।
জানা গেছে, গত দুই দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও বৈঠক করেছেন। বৈঠকে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচির ধরন নিয়ে আলোচনা হয়।