গত সপ্তাহ থেকে খোলাবাজারে ডলারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বর্তমানে আন্তঃব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের দামের ব্যবধান প্রায় আট টাকা। এই বড় ব্যবধানের কারণে হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন প্রবাসীরা। বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যাদের মাসিক আয় কম এবং যারা অবৈধভাবে প্রবাসে আছেন, তারা হুন্ডিতেই টাকা পাঠাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। এতে করে কমে যাচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা রেমিট্যান্স।
গত দেড় বছরে রেকর্ডসংখ্যক কর্মী বিদেশে গেলেও প্রবাসী আয়ের নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে হুন্ডির ব্যবহার বেড়ে গেছে।
সাধারণত হুন্ডির সঙ্গে জড়িতরা সরাসরি দালালের মাধ্যমে প্রবাসীদের থেকে ডলার সংগ্রহ করেন। এরপর তারা দেশে থাকা সহযোগীদের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের কাছে টাকা পৌঁছে দেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকিং চ্যানেল ও মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানÑ এমএফএস সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক আমাদের সময়কে বলেন, কারও একার পক্ষে হুন্ডি প্রতিরোধ সম্ভব নয়, সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। জনসচেতনতাও জরুরি। মানুষ যদি অর্থ পাঠাতে হুন্ডি ব্যবহার করেন, তা হলেই হুন্ডি বাড়বে, আর না করলে সেটা কমে আসবে। কাজেই জনগণকে সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, হুন্ডি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আমরা যেগুলো চিহ্নিত করতে পারি, সেগুলোর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও তথ্য সরবরাহ করছি।
ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ানোর পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে মেজবাউল হক বলেন, প্রণোদনা অব্যাহত আছে। আগের চেয়ে কাগজপত্র সহজ করা হয়েছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স পাঠানোর বৈধ চ্যানেলগুলোকে আরও ইফিসিয়েন্ট করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সরাসরি রেমিট্যান্স আনার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীরা সরাসরি তাদের অ্যাকাউন্টে অর্থ জমার মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত কাজের জন্য নতুন-পুরনো মিলিয়ে বিদেশে গেছেন প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ কর্মী। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানির এই ‘জোয়ারের’ বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে রেমিট্যান্স আয়ে। চলতি মাসের প্রথম ২৫ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩২ কোটি ডলার। আগের মাসে আসে ১৯৭ কোটি ডলার। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে আসে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে পৌনে তিন শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক পরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমার অন্যতম কারণ হুন্ডিপ্রবণতা বৃদ্ধি। এই পন্থায় আমাদের মাফিয়াদের এজেন্টরা বিদেশে ডলারটা কিনে নিচ্ছেন। এতে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো নির্ধারিত মূল্যের বাইরে গিয়েও অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রায় শুনি ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং (মূল্য বেশি দেখানো) করেন। এই ওভার ইনভয়েসিংয়ের কারণেও হুন্ডির চাহিদা বাড়ে। কারণ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যে মূল্যটা বেশি দেখানো হয়, সেটা হুন্ডির মাধ্যমেই পাঠানো হয়।
ব্যাংকগুলো যে দরে নগদ ডলার বিক্রি করবে, সেটির সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ টাকা যোগ করে ডলার বিক্রি করতে পারবে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। গতকাল সোনালী ব্যাংক নগদ ডলার বিক্রি করেছে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায়। এর সঙ্গে আড়াই টাকা যোগ করে ক্রেতাদের থেকে মানিচেঞ্জাররা সর্বোচ্চ নিতে পারবে ১১১ টাকা ৫০ পয়সা। আর মানিচেঞ্জাররারা এই রেটেই ডলার বিক্রি করছে বলে নিজস্ব সাইনবোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য পাঠিয়েছে। কিন্তু গতকাল কয়েকটি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এই রেটে তারা ডলার বিক্রি করছেন না। গতকাল বেশিরভাগ মানিচেঞ্জারে প্রতি ডলার বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ১১৭ টাকা ৫০ পয়সা। ফলে ব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ টাকায়। মানিচেঞ্জার ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত জুলাই ও চলতি আগস্টে ডলার কেনার ব্যাপক চাহিদা। এ সময়ে অনেকে বিদেশ ভ্রমণে যান। আবার শিক্ষার উদ্দেশে অনেকে বিদেশে গেছেন। ফলে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সরবরাহ সেভাবে বাড়েনি।
মতিঝিলে অবস্থিত পাইওনিয়ার মানিচেঞ্জারের চেয়ারম্যান মো. রোকন উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘খোলাবাজারে ডলারের সরবরাহ নেই বললেই চলে। ফলে আমরা কেনাবেচা বন্ধ রেখেছি।’ সংকটের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, খোলাবাজারে ডলার পাওয়ার মূল উৎস বিদেশ ফেরত ব্যক্তি। কিন্তু এখান থেকে সেভাবে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ডলারের চাহিদা অনেক বেশি। ফলে দামও চড়ছে।’ একই এলাকায় অবস্থিত ইয়র্ক মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা দীন ইসলাম বলেন, ‘আজকে (মঙ্গলবার) ডলারের ব্যাপক সংকট। এ কারণে দাম বেড়েছে। তাই আমরা কোনো ডলার কিনছি না, বিক্রিও করছি না।’