দুপক্ষের অনড় অবস্থানে সংঘাতের আশঙ্কা

Slider বাংলার মুখোমুখি

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মুখোমুখি দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল। বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে নির্বাচন আয়োজনে অনড় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিপরীতে বিএনপির দাবি, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার, যা সংবিধানে নেই। দুপক্ষের এমন অনড় অবস্থানের কারণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে তৎপর পশ্চিমা বিশ^। এ অবস্থায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুপক্ষের কিছুটা ছাড় দেওয়া উচিত, তাতে সমাধানের পথ বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কোনো একটা বিন্দুতে তারা একমত না হলে পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে যাবে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, দুপক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই বড় চ্যালেঞ্জ।

আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মধ্যে ১৯৯৬ সালের মার্চে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানে যোগ হওয়ার পর ওই বছর সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম ও ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়।

ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজনের রিট আবেদনে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে। ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারির পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুবছর ক্ষমতায় থাকার পর এ পদ্ধতির দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় রিট আবেদনকারী পক্ষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ। ওই সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেওয়া হয়। যদিও পরবর্তী সময় ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক স্বাক্ষরিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

আপিল বিভাগের রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের উদ্যোগ নেয় সরকার। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকালে কতিপয় বিধানের অপ্রযোজ্যতা (অনুচ্ছেদ ৫৮ ক) অনুচ্ছেদ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২ক পরিচ্ছেদসহ (অনুচ্ছেদ ৫৮ খ, ৫৮ গ, ৫৮ ঘ ৫৮ ঙ) অন্যান্য বিধান বিলুপ্ত করা হয়।
এর পর দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্বাচিত বর্তমান সরকারের অধীনে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে। এই দাবি না মানায় সংবিধানের আলোকে আয়োজিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি জোট। পরে ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি একইভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় এবং তাতে বিএনপি অংশ নেয়। এতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিএনপি ফের নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে মাঠে নামে। এ দাবিতে চলতি বছর সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন দলটির সংসদ সদস্যরা। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদের উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের সিটি নির্বাচনসহ সব ভোট বর্জন করে সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের একদফা দাবি বাস্তবায়নে নানা কর্মসূচির পাশাপাশি বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থার সহযোগিতা চাইছে।
এ অবস্থায় গত ২৪ জুন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের বিষয়ে ভিসানীতি চালুর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কানাডাও এই নীতিতে সমর্থন জানিয়েছে। এরপরই রাজপথে কর্মসূচি পালন বাড়িয়ে দেয় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির পাশাপাশি সরকারের পদত্যাগ চেয়ে গত ১২ জুলাই একদফা ঘোষণা করেছে বিএনপি। গত ১৯ জুলাই ‘এক দফা, এক দাবির’ উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল সরকারের উদ্দেশে বলেন, অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করে একটা নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। নইলে ফয়সালা হবে রাজপথে।
অপর দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সংবিধান থেকে আওয়ামী লীগ একচুলও নড়বে না। তিনি বলেন, তাদের (বিএনপির) একদফা, আমাদেরও একটাই দফাÑ সংবিধানসম্মত নির্বাচন। শেখ হাসিনাকে ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়। সর্বশেষ ?গতকাল বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকানদের আমরা যা বলেছি, আজ ব্রিটিশ হাইকমিশনারকেও ঠিক তাই বলেছি। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতোই সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ভোটের মাঠে দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যে সংসদ নির্বাচন নিয়ে তৎপর কূটনৈতিক মহল। তাদের তৎপরতা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদের পক্ষ থেকে। আবার বিদেশিদের তৎপরতা নিয়ে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজে নানা আলোচনাও চলছে।
এ অবস্থায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, জানতে চাইলে গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘দুই পক্ষ একমত না হলে একটা সংঘাতের দিকে যাবে। তারপর পারস্পরিক শক্তির ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করবে কী হয়। সংবিধান অনুযায়ী সবকিছু হতে হবেÑ এটা ঠিক; কিন্তু সংবিধান যে কোনো সময় পরিবর্তনও করা যায়। পরিবর্তিত সংবিধান অনুযায়ী সবকিছু করা যায়, এই একটা পয়েন্ট আছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ সংবিধান পরিবর্তন করবে না বলে অবস্থান নিয়েছে, সুতরাং বিএনপি যদি আন্দোলন করে একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যা ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ করেছিল, তাহলে একটা কিছু হতে পারে। এছাড়া আমি আর সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।’
এদিকে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া ‘মুশকিল’ হিসেবে দেখছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘এটা তো বলা মুশকিল। তারা এখন ডিসাইডেড। একটা রাষ্ট্রকে সুন্দর কাঠামো দ্বারা গড়ে তুলতে হয়। এ ধরনের সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত।’

অপরদিকে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি এই বিপরীতমুখী ‘অনড়’ অবস্থানে থাকে, সেখানে সমাধানের পথ নেই। সংকট সমাধানের বিষয়ে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘সমাধানের পথ বের হবে দুই পক্ষই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসে। তাদের নিজ নিজ অবস্থানে থাকলে তো সমাধানের প্রশ্নই আসে না। কে কতদূর ছাড় দিবে সেটা জানলে তখন সমাধানের চিন্তা করা যাবে। তারা যদি না বলে তাহলে সমাধান তো কেউ করতে পারবে না। এখন পর্যন্ত তারা যা বলছে, একটা অনড় অবস্থান, অনড় অবস্থানে থাকলে তো সমাধানের পথ নেই।’

কীভাবে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে তা ‘জানা নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘সমাধানের পথ আমার জানা নেই। আমি নিজে এর সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমাকে যদি বলে সমাধানের বিষয়ে বলবোÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। এটা কেউ শুনবে না, সুতরাং বলে লাভ নেই।’

প্রসঙ্গত, আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষভাগ কিংবা জানুয়ারির প্রথম দিকে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *