প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় গত কয়েক বছরে বিপুল বিনিয়োগ করেছে সরকার। প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা-মর্যাদা। এর পরও বিভিন্ন জরিপে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ শিখন মানে হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, দায়িত্ব পালনে প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষকরা সফল নন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। মাঠপর্যায়ের পরিদর্শনেও আছে দায়িত্ব অবহেলা।
সম্প্রতি বেসরকারি সংগঠন ওয়েব ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘নাগরিক কর্তৃক মূল্যায়ন’ শীর্ষক এক জরিপে প্রাথমিকের পাঠ শিখনে হতাশার চিত্র উঠে আসে। কোনো না কোনো সময় বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৭৫১ ছেলে ও ৭৮২ মেয়েশিশুর ওপর জরিপটি করা হয়েছে। তবে এটি বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষার্থীদের জরিপ নয়। ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী প্রান্তিক শিশুদের বাড়িতে গিয়ে এই মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে জরিপটি করা হয়।
জরিপে দেখা যায়, ১০ শতাংশের বেশি ছেলে এবং প্রায় ৯ শতাংশ মেয়ে বাংলায় বর্ণ পড়তে পারেনি। ইংরেজিতে এই হার আরও বেশি। এ ছাড়া বাংলায় গল্প পড়তে পারেনি প্রায় ৬২ শতাংশ ছেলে ও ৫৩ শতাংশ মেয়ে।
জরিপের তথ্য বলছে, ইংরেজিতে বর্ণ পড়তে পারেনি ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ ছেলে এবং ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ মেয়ে। ইংরেজিতে গল্প পড়তে পারেনি প্রায় ৮৫ শতাংশ ছেলে ও প্রায় ৮৩ শতাংশ মেয়ে। এ ছাড়া গণিতে একক অঙ্ক শনাক্ত করতে পারেনি ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ ছেলে এবং ১৩ শতাংশ মেয়ে। আর ভাগ করতে পারেনি প্রায় ৯৬ শতাংশ ছেলে এবং ৯৭ শতাংশের বেশি মেয়ে।
জরিপ প্রতিবেদনে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকসংখ্যা বাড়ানো, শ্রেণির পড়া শ্রেণিতেই সম্পন্ন করা, শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণে গুরুত্বারোপসহ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সরকার রূপকল্প-২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নে প্রাথমিক শিক্ষায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে, নানা ধরনের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। স্কুলের জাতীয়করণ, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, মর্যাদা বৃদ্ধি, জীবনমান উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছায়নি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা। ক্ষোভ প্রকাশ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার মাঠে পর্যাপ্ত সার, পানি ও পরিচর্যা করছে অথচ ভালো ফসল ঘরে তুলতে পারছে না। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। সরকারের ভিশন বাস্তবায়নে দায়িত্বশীল ও জবাবদিহি করতে হবে সবাইকে।’
এর আগে করোনাকালে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। দেশের ১৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর ওপর জরিপে বলা হয়, মহামারীর আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অবিলম্বে এসব ক্ষতি ও ঘাটতি পূরণ না হলে একটি দক্ষতাহীন প্রজন্ম তৈরি হতে পারে।
তবে এনসিটিবির গবেষণা ফলাফলের সঙ্গে একমত নন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ঘাটতি পূরণের যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মহামারীর কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান বন্ধ ছিল। তবে ওই সময়ে টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইনে ক্লাস নেওয়াসহ নানাভাবে শিক্ষার্থীদের শেখানোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা হয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ বলেন, করোনাকালে শিক্ষায় যে বিরাট ক্ষতি হয়েছে, সেটি স্বীকার করতে যেন একটু ইতস্তত ছিল। এখন গবেষণার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষতি স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৬২০টি। বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৮টি। সরকারি ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৬ জনসহ মোট প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয়ের শিক্ষক আছেন ৭ লাখ ২১ হাজার ৮০১ জন। এসব বিদ্যালয়ে পড়ছে ২ কোটি ১ লাখ ২২ হাজার ৩৩৭ জন।