অস্বস্তির সময়ে কঠিন বাজেট আজ

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় টানাপড়েন চলছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে সম্প্রসারণ থেকে সংকোচনমূলক বাজেট দিতে হচ্ছে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফলে ভোটার তুষ্টির জন্য সম্প্রসারণমূলক এবং কর ছাড় দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করতে হয়। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতি সচল রাখতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হতে হয়েছে। ফলে আইএমএফের নানা শর্তের কারণে সরকারের ইচ্ছার বাইরেও অনেক সংস্কার করতে হচ্ছে। ভর্তুকি কমানো, কর আহরণ বাড়ানোসহ নানা রকমের অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে কঠিন বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আজ বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর জাতীয় সংসদে পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা প্রস্তাবিত বাজেট হিসাবে দীর্ঘ আলোচনার পর ২৫ জুন অর্থবিল এবং ২৬ জুন বাজেট পাস হবে। আর কার্যকর হবে ১ জুলাই থেকে। এটি সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট। আর বর্তমান অর্থমন্ত্রীর পঞ্চম বাজেট।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার শর্ত পূরণের প্রতিফলন থাকছে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে। তাই ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ যা যা করতে বলেছে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেট বক্তব্যে সেগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করার ঘোষণা থাকবে। সরকার নিজের মতো করেই এত দিন বাজেট প্রণয়ন করে আসছিল। গত ৩০ জানুয়ারি ঋণ অনুমোদনের পর নতুন বাজেটে এখন বাধ্য হয়েই আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ রাখা হচ্ছে। থাকছে কিছু সংস্কারের ঘোষণাও।

জানা গেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার বছরে আমজনতাকে তুষ্ট করতে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বিশাল ঘাটতির বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। এ ঘাটতি বাজেটের কারণে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক উল্লম্ফনের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ঘাটতির অর্ধেকের বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক হতে ঋণ করে পূরণ করার পরিকল্পনা করেছে সরকার। এ ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির অংশ হিসেবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে একই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল।

জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে। আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ

কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আসবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব খাতবহির্ভূত (নন-এনবিআর) থেকে আয় হবে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে (এনটিআর) ৫০ হাজার কোটি টাকা।

সাবেক তত্ত্বাবধায় সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সরকারের আয় কম হবে বলেই ব্যাংক থেকে আগামী বাজেটে বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হলে নতুন টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়। এর প্রভাব সরাসরি মূল্যস্ফীতির ওপর পড়ে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমাতেই হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে গেলে মানুষের দুর্ভোগও বেড়ে যাবে। এ জন্য সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের রাশ টানা দরকার, যাতে আগামীতে বাজেট ঘাটতি কম হয়।

জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৮৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৭৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছর এনবিআরে লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ২৭ হাজার ১২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ফলে নিট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে আগামী অর্থবছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার প্রাক্কলন করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ২৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে জিডিপির আকার ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।

এদিকে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার পাওয়ার অন্যতম শর্ত হলো- আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে স্বাভাবিক প্রবণতার অতিরিক্ত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ আদায় করতে হবে। এনবিআর হিসাব করে দেখেছে, আগামী অর্থবছরের অতিরিক্ত ৪৮ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। করছাড়ও কমিয়ে আনতে হবে।

আইএমএফের শর্ত পূরণে আগামী বাজেটে বিভিন্ন খাতে কর বসিয়ে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা থাকবে। আবার কিছু প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। যেমন ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে কর বাড়াতে একটি বিশেষ ডিজিটাল ডাইরেক্ট ট্যাক্স ইউনিট গঠনের ঘোষণা বাজেটে থাকতে পারে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক কর ইউনিট ও ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের জন্য আলাদা ইউনিট গঠন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এনবিআর মনে করছে, আয়কর খাতে এসব সংস্কারের ফলে আগামী তিন বছরে আয়কর আদায়ের পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে। করছাড় কমানোর উদ্যোগ নিতে বলেছে আইএমএফ।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আপাতত করছাড় কমানোর বড় উদ্যোগ থাকবে না বাজেটে। ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে বেশির ভাগ করছাড় সুবিধার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। যৌক্তিক কারণ ছাড়া আর কোনো করছাড়ে মেয়াদ বাড়াতে চায় না এনবিআর। কিছু কিছু পণ্যের বিদ্যমান কর রেয়াত সুবিধা তুলে দেওয়া হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের আমদানিতে শুল্কহার বাড়ানো হচ্ছে। শূন্য আয় (করযোগ্য সীমার নিচে বার্ষিক আয়) দেখিয়ে বিনাপয়সায় বর্তমানে রিটার্ন জমা স্লিপ (প্রাপ্তি স্বীকারপত্র) পাওয়া যায়। এখন আর বিনাপয়সায় রিটার্ন জমা স্লিপ পাওয়া যাবে না। করযোগ্য আয় না থাকলেও আগামীতে রিটার্ন জমা স্লিপ নিতে দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। আর রিটার্ন জমার স্লিপ না নিলে সরকারি-বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে না। এভাবে নানাভাবে করের জাল বিস্তার করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এমনিতেই সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর ওপর নতুন করে করহার বাড়ানো হলে বাজেটের পর পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। এতে জনদুর্ভোগ আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ আমাদের সময়কে বলেন, কঠিন সময়ের কঠিন বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে তা অর্জন করা কঠিন। রাজস্ব আহরণ না বাড়লে ব্যাংক ঋণ বাড়বে। এতে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে।

সামাজিক সুরক্ষা খাতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে কিছু কিছু কর্মসূচিতে ভাতাও। কোথাও বাড়ছে জনপ্রতি ৫০ টাকা, কোথাও ১০০ টাকা। ভাতা কিছুটা বৃদ্ধির পাশাপাশি উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ হতে পারে ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, এবারের বাজেটের মূল দর্শন-২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। গত দেড় দশকে বর্তমান সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের অর্জন একটি টেকসই গ্রাউন্ডওয়ার্ক বা ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করে দিয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ চারটি মূল স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি এবং স্মার্ট ইকোনমি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটটি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে প্রথম বাজেট। এবারের বাজেটে সঙ্গত কারণেই স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *