দেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে রংপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি দরিদ্রের বাস। আর সবচেয়ে বেশি ধনী পরিবারের বসবাস ঢাকা বিভাগে। রংপুর বিভাগে বসবাসরত পরিবারগুলোর মধ্যে ৪৪ দশমিক ২ শতাংশই অতিদরিদ্র (পুওরেস্ট)। অন্যদিকে ঢাকায় অতিদরিদ্র পরিবার ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
অতিদরিদ্র পরিবারের হিসাবে রংপুরের পরেই রয়েছে যথাক্রমে ময়মনসিংহ (৩৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ), রাজশাহী (২৯ দশমিক ২৯ শতাংশ), বরিশাল (২৭ দশমিক ১৭ শতাংশ), সিলেট (২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ), খুলনা (২১ দশমিক ৪২ শতাংশ), চট্টগ্রাম ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর সবার শেষে আছে ঢাকা।
অঞ্চলভিত্তিক এ বৈষম্য দূর করতে আয়বৈষম্য হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি উপার্জনের জন্য বিদেশে কর্মসংস্থানে যেতে সহায়তা করা ছাড়াও শিল্পায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাজেটে বৈষম্যহীন জেলাভিত্তিক বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ বরাদ্দের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করতে হবে।
গত ১৭ এপ্রিল পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষে থাকা ঢাকা বিভাগে ধনী পরিবার ২০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে খানা হিসাবে দেশে মোট দরিদ্র পরিবার ২৪.১৮ শতাংশ, যেখানে ধনী পরিবারের সংখ্যা ১৩.৬২ শতাংশ। এতে আরও বলা হয়েছে, দেশের সব বিভাগে অন্তত ১২.৩০ শতাংশ পরিবার দরিদ্রের তালিকায় রয়েছে। প্রতিবেদনে দেশের গ্রামাঞ্চল, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সম্পদের সূচক নির্দেশ করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে মাত্র ৭.১৭ শতাংশ পরিবার রয়েছে ধনীর তালিকায়; দরিদ্রের তালিকায় রয়েছে ২৯.২৯ শতাংশ পরিবার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশনের মাত্র ৩ শতাংশ পরিবার দরিদ্র এবং ৪৭.৮৬ শতাংশ পরিবার ধনীর তালকায় রয়েছে। শহর এলাকায় ধনী পরিবারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং দরিদ্রের হার সবচেয়ে কমÑ জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। সারাদেশের দুই হাজারেরও বেশি এলাকার তিন
লাখেরও বেশি পরিবারের ওপর এ জরিপ চালানো হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে জরিপের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়, জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপেও দেখা গেছে, দেশে সর্বাধিক দরিদ্র পরিবার ছিল রংপুর বিভাগেই (৪৭ শতাংশ)। সে সময়ও ময়মনসিংহ ছিল রংপুরের পরেই। এ বিভাগে সে সময় দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ।
এদিকে বিবিএস বলছে, এই জরিপের ওয়েলথ কুইন্টাইল একটি দেশের রিলেটিভ ওয়েলথ বা আপেক্ষিক সম্পদ এবং ইক্যুইটি বুঝতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে অ্যাবসলিউট ওয়েলথের ধারণা পাওয়া যায় না। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সম্পদের র্যাঙ্কিংয়ে পরিবারগুলোকে ভাগ করার জন্যই সূচকটি চালু করেছে বিবিএস।
স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদন-২০২১-এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ‘ওয়েলথ কুইন্টাইল ইনডেক্স’ বা সম্পদ সূচক চালু করেছে বিবিএস। এর মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নির্ণয় করা সহজ হবে বলে জানিয়েছেন বিবিএস কর্মকর্তারা। সূচকটি গৃহস্থালির নির্মাণসামগ্রী, পানি, স্যানিটেশনসহ টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটরের মতো বিভিন্ন জিনিসের মালিকানা নথিভুক্তির মাধ্যমে স্কোর তৈরি করে। আর এই স্কোরের ভিত্তিতেই সম্পদ সূচকে পরিবারগুলোর র্যাঙ্কিং নির্ধারিত হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আদিকাল থেকেই দেশের যেসব অঞ্চল দরিদ্রতম, সেসব অঞ্চল এখানো দরিদ্রই রয়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বাজেট বৈষম্য। দরিদ্র অঞ্চলগুলোকে অন্যান্য অঞ্চলের মতো সমান তালে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কম থাকায় এ অবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়ন হলেও এসব অঞ্চলের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরও যেসব প্রয়োজন যেমনÑ অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পায়ন, আয়-বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকার কারণে বৈষম্য কমেনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, দেশে আঞ্চলিক বৈষম্য অনেক বেশি। বিশেষ করে রংপুর, কুড়িগ্রাম অঞ্চলের মানুষ বেশি বৈষম্যের শিকার। দারিদ্র্য দূর করতে হলে এসব অঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি কৃষি খাতের ওপর গুরুত্ব দেওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন উন্নয়ন সত্ত্বেও আঞ্চলিক বৈষম্য, আয় বৈষম্য এবং সম্পদবৈষম্য এখনো বিদ্যমান। এমনকি আমাদের সাধারণ আয়বৈষম্যও সারাদেশে বেড়েছে।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, আমরা যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পদের কথা বলি, সেই দর্শনের সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক। বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে যেন দারিদ্র্য বিমোচন হয়। তিনি বলেন, অঞ্চলভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করে সেখানে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য জেলা বাজেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেসব অঞ্চল বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে সেখানে কীভাবে কর্মসংস্থান বাড়ানো যায়, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসা যায়, সরবরাহ বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে ঋণ, কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।
দারিদ্র্য অঞ্চলগুলোর মানুষ বৈদেশিক বাজারে কম। বিদেশে যেতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, তা জোগান দেওয়ার সামর্থ্য নেই এসব অঞ্চলের মানুষের। এক্ষেত্রে তাদের কীভাবে সহযোগিতা করা যায়Ñ যেমন সরকার টু সরকার যদি চুক্তিবদ্ধ হয়, সেটিও দারিদ্র্য বিমোচনের বড় হাতিয়ার হতে পারে, বলেন তিনি।