ঈদে সন্তানদের নিয়ে কোথাও বের হতে পারিনি’

Slider বিচিত্র

‘গতকাল ঈদ ছিল, আমি সন্তানদের নিয়ে কোথাও বের হতে পারিনি। সারাদিন বাড়িতেই কেটেছে। হয়তো কিছু টাকা পেয়েছি, কেউ একটা বাড়ি করে দিয়েছে, কিন্তু কেউ কি আমার হারানো পা দুটো ফিরিয়ে পারবে? যা দিয়ে আমি আগের মতো স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বেড়াব।’ কান্না জড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসে দুই পা হারানো দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর পঙ্গু রেবেকা খাতুন।

তিনি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাই চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের মোস্তাফিজার রহমানের স্ত্রী রেবেকা খাতুন।

আজ রোববার দুপুরে রানা প্লাজা ধসে দুই পা হারানো রেবেকা খাতুন এবং ওই ঘটনায় নিখোঁজ উপজেলার কাজিহাল ডাঙ্গা গ্রামের গুলশান আক্তার শাবানার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন দৈনিক আমাদের সময়ের প্রতিবেদক।

আগামীকাল ২৪ এপ্রিল, ভয়াবহ রানা ট্র্যাজেডির ১০ বছর। রানা প্লাজার ভয়াবহ দুর্ঘটনায় দুই পা হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন রেরেকা। আজও তার কান্না থামেনি। দুই পায়ে জরুরি অপারেশন করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু করতে পারেনি।

রেবেকা বলেন, ‘ঘটনার আগের দিন ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল দেখে বিকেল ৪টায় ছুটি দিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। পরদিন সকাল ৮টায় কাজে এসে বিল্ডিংয়ে ফাটলের কারণে কাজে যোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে রানা প্লাজার কর্তৃপক্ষ বলেন, বেতন-ভাতাসহ ওভারটাইমের টাকা দেওয়া হবে না এবং চাকরিচ্যুত করা হবে। টাকা ও চাকরি হারাবার ভয়ে সব শ্রমিকের সঙ্গে তিনিও কাজে যোগ দেন। ভবন ধসে পড়লে অচেতন হয়ে তিনদিন আটক পড়ে ছিলাম ওই বিল্ডিংয়ের ধ্বংসস্তূপের নিচে। পরে উদ্ধারকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করায়। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হাসপাতালে বিছানায় আবিষ্কার করি। আরও পরে জানাতে পারি আমার দুটি পা নেই। এরই মধ্যে তার দুই পায়ে ৮ বার অপারেশন কারা হয়েছে। ১ বছর ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরি। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো ভবন ধসে নিখোঁজ আমার মা চান বানু ও দাদি কোহিনুর বেওয়াকে আজও খুঁজে পাইনি ‘

এদিকে এরই মধ্যে তার পঙ্গুত্ব জীবনে আসে প্রথম সন্তান ছিদরাতুন মুনতাহা। বর্তমান তার বয়স প্রায় ৯ বছর। পড়ছে বারাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে। অপর সন্তান মাদানী আন নুর তিন বছরের। পঙ্গুত্বের কারণে সন্তানদের তিনি সময় দিতে পারেন না।

রেবেকা খাতুন আরও বলেন, ‘সরকারি নিয়ম অনুযায়ী দুই পা হারানোর ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৫ লাখ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু সেই সময় চিকিৎসা জনিত কারণে ক্ষতি পূরণের ৫ লাখ টাকা কম পেয়েছি। ১৫ লাখ টাকার স্থলে পেয়েছি ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। সেই সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ হিসেবে প্রতি মাসে ৯ হাজার ১০০ টাকা করে পাই। তাই দিয়ে আমার সংসার চলছে।’

একটি বেসরকারি সংস্থা তার দুটি কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কোথাও গেলে ও পা লাগিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা একটু কষ্টকর। স্বামী ছাড়া তেমন চলাফেরা করতে পারেন না তিনি। ২০২১ সালে তাদের ৫ শতাংশ জমিতে একটি বেসরকারি সংস্থা পাকা টিনসেডের বাড়ি করে দিয়েছে বারাই হাট এলাকায়। কিন্তু সেখানেও থাকতে পারেন না। কারণ আশপাশে তেমন বাড়ি নেই।

আক্ষেপ করে রেবেকা খাতুন বলেন, ‘পা হারিয়ে আজ কর্মহীন হয়ে সারাদিন বাড়িতে বসে কাটাতে হয়। স্বামী সন্তানের প্রয়োজনে তেমন কাজে আসতে পারি না। হয়তো কিছু টাকা পেয়েছি, কেউ একটা বাড়ি করে দিয়েছে, কিন্তু কেউ কি আমার হারানো দুটি পা ফিরিয়ে দিতে পারবে? যা দিয়ে আমি আগের মতো স্বাভাবিকভাবে হাঁটা-চলা করতে পারব?’

অপরদিকে উপজেলার কাজিহাল ইউনিয়নের ডাঙ্গা গ্রামের আতাউর রহমানের স্ত্রী গুলশান আক্তার শাবানার স্বামী আতাউর রহমান জানান, প্রতিদিনের মত শাবানা ওইদিন রানা প্লাজায় কাজ করতে যায়। ঘটনার পর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে নিখোঁজ তালিকায় শাবানার নাম ছিল। নিখোঁজ তালিকার সূত্র ধরে সেই সময় ১৩ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ পেয়েছি কিন্তু পাইনি স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রীর মরদেহ।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধস বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনার একটি। এতে ১১৩৮ জন পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও দুই সহস্রাধিক শ্রমিক। মানবসৃষ্ট ভয়াবহ সেই বিপর্যয়ের রেশ রয়ে গেছে এখনো। আহতদের অনেকে এখনো আতঙ্কগ্রস্ত। এরই মধ্যে বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন পথ খুঁজছেন তারা; এখনো অনেকেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ঘুরে দাঁড়ানোর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *