আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া বিএনপি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী দিচ্ছে না; আগের মতো নেই জামায়াত, নেই তাদের কোনো প্রার্থীও। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। নির্বাচনী বৈতরণী উতরে যেতে লিটনের সামনে বড় কোনো বাধা নেই আপাতদৃষ্টিতে।
কিন্তু সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিএনপি-জামায়াত সরাসরি নির্বাচন না করলেও লিটনকে ঠেকাতে ভোটের মাঠে কৌশলে সক্রিয় হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ‘ডামি’ প্রার্থী দেওয়া হতে পারে কিংবা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীকে সক্রিয় সমর্থন দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে লিটনের জন্য ভোটযুদ্ধ খুব একটা সহজ হবে না। যদিও এমন গুঞ্জন আমলে নিচ্ছেন না ইসলামী আন্দোলনের নেতারা। তারা বলছেন, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আামাদের কোনো সম্পর্ক নেই। হাতপাখা এবার আর আওয়ামী লীগের প্রার্থীকেও ছাড় দেবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ভোটযুদ্ধে তারাই বিজয়ী হবেন।
রাসিক নির্বাচনে বড় দুই দলের মধ্যে যে লড়াই চলে, এবারের নির্বাচনে গতানুগতিক সেই ধারা নেই। এর পরও নৌকার টিকিট হাতে পেয়ে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছেন লিটন। আগেভাগেই মাঠ গুছানোর কাজে হাত দিয়েছেন। দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন কমিউনিটির সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের বাকি আছে এক মাসেরও বেশি সময়। কিন্তু এ সময়টা নষ্ট করতে চান না নৌকার প্রার্থী। পাশাপাশি এও বলেছেন, ফাঁকা মাঠে তিনি গোল দিতে চান না; চান বিএনপিও নির্বাচনে আসুক। জনগণের কাছে জনপ্রিয়তার পরীক্ষা হয়ে যাক।
১৪ দলের শরিকরাও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বর্তমান মেয়র লিটনের বাইরে কিছু ভাবছেন না; অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছেন তাকে। গত শনিবার দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মনোনয়ন বোর্ডের সভায় বর্তমান মেয়র লিটনকে রাসিক নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এ খবরে নেতাকর্মীদের মাঝে বিপুল আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। লিটনকে অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসান তারা। মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন লিটন, আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী লিটনকে নির্দেশ দেনÑ ফের বিজয়ী হতে উন্নয়নের বার্তা নিয়ে ভোটারদের কাছে যেতে।
নৌকার টিকিট পাওয়ার পর প্রতিদিনই লিটনের সমর্থনে নানা কর্মসূচি চলছে। লিটন বলছেন, আসন্ন নির্বাচনে জয়যুক্ত হলে অন্ততপক্ষে পঞ্চাশ হাজার বেকার তরুণ-তরুণীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করবেন। তিনি বলেন, গত দুই মেয়াদে আমি মেয়র থাকাকালে গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটির জন্য রাজশাহী সিটি করপোরেশন পরপর চার বার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। আমি পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হলে এই ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আরও অত্যাধুনিক সিটি গড়তে যা যা করা দরকার তা করব। রাজশাহীতে বিসিক শিল্পনগরী-২ ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে। সেখানে নারী উদ্যোক্তাদের কর্মসংস্থানের জন্য ৫০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনা জামানতে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে যেন রাজশাহীতে কেউ বেকার কিংবা কর্মহীন না থাকে।
লিটন আরও বলেন, আমরা সব সময়ই বিএনপিকে ভোটে আসার আহ্বান জানিয়ে আসছি। কিন্তু তারা না এলে আমাদের কিছু করার নেই। আর ১৪ দলের শরিক দলগুলোর সঙ্গে শিগগিরই আমরা বসব। তারাও নিশ্চয়ই আমাকেই সমর্থন দেবে। এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
এদিকে রাসিক নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও প্রকাশ্যে বিএনপির কাউকে দেখা যাচ্ছে না অতীতের মতো। কিন্তু কেউ কেউ মনে করছেন, দলীয়ভাবে প্রার্থী না দিলেও শেষ পর্যন্ত কৌশলে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করাতে পারে বিএনপি। টানা ১৭ বছর রাসিকের মেয়র ছিলেন বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিনু। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির এই প্রার্থীকে হারিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ নেতা এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। মাঝে ২০১৩ সালের নির্বাচনে লিটনকে হারিয়ে মেয়র হন বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। কিন্তু ২০১৮ সালে আবারও বিএনপি নেতা বুলবুলকে হারিয়ে মেয়র হন লিটন।
রাজশাহী এক সময় বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। এর পরও হারানো মসনদ পুনরুদ্ধারে কৌশলী হতে পারে বিএনপি। তারা দলীয় মনোনয়ন ছাড়াই তৃতীয় সারির কোনো নেতাকে গোপনে সমর্থন দিয়ে প্রার্থী করতে পারে। বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ সুইট মেয়র পদে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও মেয়র পদে মনোনয়ন উত্তোলন করেছিলেন সুইট। যদিও শেষ মুহূর্তে তা প্রত্যাহার করে নেন। এবারও সুইট ভোটের মাঠে নামতে পারেন বলে ধারণা করছেন অনেকেই। তবে সুইট তা অস্বীকার করে জানিয়েছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি এবার নির্বাচন করবেন না।
বিএনপি যে ভোটের মাঠে তার বিপক্ষে কৌশলী ভূমিকা নিতে পারে, তা লিটনের ভাবনায়ও রয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত সব সময় চোরা পথ পছন্দ করে। তারা জনগণকে ভয় পায়। এজন্য সরাসরি ভোটে আসতে চায় না। হয়তো কৌশলে কাউকে দাঁড় করিয়ে দিতেও পারে।
এবারের ভোটে কোমর বেঁধে মাঠে নামতে প্রস্তুত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন মাত্র তিন হাজার। তবে ২০২২ সালে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলটি বেশ চমক দেখিয়েছে। রংপুরের ফল দেখে তারা রাজশাহীতেও স্বপ্ন দেখছে।
যোগাযোগ করা হলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজশাহী মহানগরীর সভাপতি তারিক উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিএনপি তো নির্বাচনে আসছে না। আওয়ামী লীগ শুধু থাকছে। কাজেই আমরা কোনো ছাড়ই দেব না। নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। গেল দুই নির্বাচনে শফিকুল ইসলাম মেয়রপ্রার্থী ছিলেন। কিন্তু এবার আমরা প্রার্থী পরিবর্তন করব। কেন্দ্রে সম্ভাব্য তিনজনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। ২-১ দিনের মধ্যেই কেন্দ্র থেকে আমাদের মেয়রপ্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।
এর আগে, ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ছিলেন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এক লাখ ৬৫ হাজার ৩৩২ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ৩১২ ভোট। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ জুনের সিটি নির্বাচনে আনারস প্রতীকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে বুলবুল এক লাখ ৩৮ হাজার ৫৮ ভোট পেয়ে রাজশাহী সিটির মেয়র হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ৮৩ হাজার ৭২৬ ভোট পেয়েছিলেন বর্তমান মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। এর আগে ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে হারিয়ে প্রথমবার রাজশাহী সিটি মেয়র নির্বাচিত হন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। ওই নির্বাচনে লিটন ৯৮ হাজার ৩৬০ ভোট পেয়ে মেয়র হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বুলবুল পেয়েছিলেন ৭৪ হাজার ৫৫০ ভোট।
১৯৯১ সালের ২১ মে অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে মেয়র হন বিএনপির মিজানুর রহমান মিনু। তিনি একটানা ১৭ বছর রাজশাহী সিটি মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। অতীতে হওয়া রাজশাহী সিটির পাঁচটি নির্বাচনই ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।