মাসুদ রানা সরকার, বগুড়া জেলা প্রতিনিধি: সারাদেশে এবারও মরিচের চরা বাজার হওয়ায় কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। বগুড়ায় উৎপাদন হয়েছে অন্তত ৭শ’ কোটি টাকার মরিচ। বিগত সময়গুলোকে হার মানিয়ে এবার সর্বোচ্চ মুনাফা ঘরে তুলেছে কৃষকরা। এর মধ্যে শুধু সারিয়াকান্দি উপজেলায় মরিচের ফলন হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকার।
মরিচ ও লাল মরিচের জন্য বিখ্যাত বগুড়া। প্রতি বছর উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোতে মরিচের অধিকাংশ চাহিদা পূরণ করে থাকে বগুড়ার মরিচ। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এবার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭,২৫০ হেক্টর, অর্জিত হয়েছে ৫,৬৫০ হেক্টর। প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে ১৩ মেট্রিক টন ধরে অর্জিত ফলন ৭৩,৪৫০ মেট্রিক টন। কাঁচা মরিচের আওতায় জমির পরিমাণ ২,৯৪০ হেক্টর ও উৎপাদন ৩৯,৬৯০ মেট্রিক টন। শুকনা মরিচের আওতায় জমির পরিমাণ ৩,৫৮৯ হেক্টর ও উৎপাদন ১০,২২৮ মেট্রিক টন। কাঁচা মরিচের মোট বিক্রয় মূল্য প্রায় ৪৭৭ কোটি টাকা ও শুকনো মরিচের বিক্রয় মূল্য প্রায় ৪১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৮৮৭ কোটি টাকার মরিচ ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এই জেলায়।
গত বছরের চেয়ে মরিচের আবাদ ও উৎপাদন কম হলেও বাজার মূল্য বেশি থাকায় রপ্তানিতে আয় বেড়েছে কৃষকদের। এতে করে মরিচের প্রতি ফের আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। আগামী বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্জিত বেশি হবে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।
জেলায় উলেস্নখযোগ্য হারে মরিচ উৎপাদন হয়ে থাকে সারিয়াকান্দি ও সোনাতলার যমুনা চরে। এই দুই উপজেলার মধ্যে সারিয়াকান্দিতে বেশি আবাদ হয়। প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সারিয়াকান্দির যমুনা চরে। এবার মরিচের আবাদ হয়েছে ৩,১৭০ হেক্টর জমিতে। আর সোনাতলায় আবাদ হয়েছে ১০১০ হেক্টর জমিতে। এছাড়া অন্যান্য উপজেলাগুলোর মধ্যে সদরে ৭০ হেক্টর, শাহাজানপুরে ২১৫, শেরপুরে ১৫০, ধুনটে ৩০০, শিবগঞ্জে ২৫০, কাহালুতে ৫০, দুপচাঁচিয়ায় ৪৫, আদমদীঘিতে ৩৫ ও নন্দীগ্রামে চাষ হয়েছে ২৫ হেক্টর জমিতে। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, শুধু সারিয়াকান্দির যমুনা চরে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। কৃষি বিভাগ বলছে, মরিচ একটি অত্যন্ত অর্থকরী ফসল এই ফসল থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে যমুনা চরের বানভাষী মানুষগুলো দুর্যোগকালীন সময়ে মোকাবিলা করে থাকে। মরিচ চাষের সময়টুকুতে তেমন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকে না। তাই একটু যত্নের মাধ্যমে ভালো ফসল ফলাতে পারলেই বেশ ভালো মুনাফা ঘরে তুলতে পারবেন তারা।
এখন জমি থেকে কাঁচা মরিচ উঠানো প্রায় শেষ, লাল মরিচ আছে অল্প কিছু জমিতে। চলছে লাল মরিচ সংগ্রহ ও বাজারজাত করার প্রক্রিয়া। চরাঞ্চলে গেলেই দেখা মিলবে মরিচ গাছে সবুজ পাতা নেই, আছে শুধু লাল মরিচ, অর্থাৎ লাল মরিচের কারণে জমিটিই লাল হয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও সাদা বালির উপর মরিচ শুকাতে দেয়ায় দূর থেকে দেখে মনে হবে লাল গালিচায় ঢেকে দেওয়া হয়েছে চরের সাদা বালি। শুকাতে দেওয়া এসব মরিচ হিমাগার অথবা বাজারের উপযোগী করে তুলতে কাজ করছেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা। তারা কোয়ালিটি ভেদে কয়েকটি অংশে এসব মরিচ বাছাই করছেন। শুকানো শেষে এসব মরিচ বাজারে অথবা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে গোডাউনে রাখা হয়। আবার কিছু কিছু ব্যবসায়ীরা হিমাগারেও রেখে দেয়। তবে এবার বাজারে লাল মরিচের চাহিদা ও দাম প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় জমি অথবা আড়ত থেকেই বেশি বিক্রি হচ্ছে। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি লাল মরিচের দাম ১৪০-১৭০ টাকা পর্যন্ত। বিগত দিনে অর্থাৎ গত বছরেও লাল মরিচ বিক্রি হয়েছে ৫০-৭০ টাকা পর্যন্ত। জমি থেকে এসব লাল মরিচ সংগ্রহ করে শুকানো হলে ৪-৫ কেজি শুকিয়ে ১ কেজি হয়। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি শুকনো মরিচ ৪০০ থেকে শুরু করে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
সরেজমিন সোনাতলা উপজেলার তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের চুকাইনগর, চর সুজাইতপুর, সুজোলের পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কথা হয়, আবুল কালাম, হামেদ আলী, আজিজুল ইসলাম, আলাউদ্দিন, জামিরুল ইসলাম, জিয়ারুল, উজ্জল, শাহ্ আলম, আনিছুর রহমানসহ বিভিন্ন কৃষকের সঙ্গে। এছাড়া সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ি ও কুতুবপুর ইউনিয়নের জব্বার বেপারী আশরাফ আকন্দ, কালাম মিয়া, কিনে শেখ, মাজেদুর রহমান, আশাদুল ইসলাম, রবি আহমেদসহ অন্যান্য কৃষকদের সঙ্গে তারা বলেন, ‘বিগত দিনের চেয়ে এবার মরিচের ফলন কিছুটা কম হলেও বাজার ভালো থাকায় অনেক লাভবান হয়েছি আমরা। প্রতিবিঘা জমির মরিচ থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এতে করে আগামীতে মরিচ চাষে কৃষকরা আরও বেশি আগ্রহী হবেন। তারা আরও বলেন, গত বছর চরাঞ্চলে হাইব্রিড জাতের মরিচের বেশি আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে ছনিক ও বিজলী পস্নাস উলেস্নখযোগ্য। তবে চড়া মূল্যে এসব প্যাকেট বীজ কিনে কৃষকরা প্রতারিত হয়েছেন। যার কারণে এবার দেশি জাতের মরিচের চাষ বেশি হয়েছে।
মরিচ চাষ ও মরিচের নানা বিষয়ে বগুড়া কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মতলুবর রহমান বলেন, ‘মরিচ একটি সংবেদনশীল ফসল। এই ফসল থেকে ভালো কিছু পেতে হলে কৃষক ভাইদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়। তাদেরকে অনেক যত্নবান হতে হয়। কারণ একটু খানি ভুল সিদ্ধান্ত ও অবহেলার কারণে বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
উলেস্নখ্য, চরাঞ্চলের মানুষের দুর্যোগকালীন সময়ে বেঁচে থাকার একমাত্র ফসলের নাম মরিচ। এই ফসলের প্রতি তাদের রয়েছে মায়া, মমতা, ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধাসহ অজস্র সম্মান। তাদের বিশেষ আকুতি কৃষি বিভাগ যেন তাদের পাশে থাকে। তারা দাবি জানান, মরিচসহ নানা ধরনের ফসলের বীজ ও সারসহ বিভিন্ন প্রণোদনাগুলো সঠিক সময়ে বিতরণ করার জন্য।