পদার্থবিজ্ঞানে এ পর্যন্ত মোট চারজন নারী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এদের একজন আন্দ্রে গেজ। যুক্তরাষ্ট্রের এই জ্যোতির্পদার্থবিদ ২০২০ সালে নোবেল পান। আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে কী আছে, তা নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প বলেছেন নোবেল কমিটিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। ইংরেজি থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদ করেছেন আমাদের সময়ের সহকারী সম্পাদক জাহাঙ্গীর সুর
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। মানে, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বলা সহজ- ওটা এরকম ছিল, ওরকম হতে পারত। আমরা যা করি তার প্রতি আমাদের আগ্রহের উৎস নিয়ে কথা বলা তেমনই সহজ বটে। আমার মনে হয়, চাঁদে অবতরণের সেই বাঁকবদলের মুহূর্তই আমাকে বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তুলেছিল। তখন আমার বয়স মাত্র চার বছর। কিন্তু তখনই ওই ঘটনা মহাশূন্য ও মহাকাশের বিশালতা সম্পর্কে আমার মনে গভীর ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। পাশাপাশি এ কথা বলে দেওয়া উচিত যে, আমি তখন একজন মহাকাশচারী হতে চেয়েছিলাম এবং একই সময়ে একজন ব্যালে নৃত্যশিল্পী হতে চেয়েছিলাম। তাই শিশু হিসেবে আমি সত্যিই বিজ্ঞানকে আমার আগ্রহের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, এটা বলা যায় না আদোতে।
তবে একটা বিষয় সত্যি- ওই সময় থেকেই আমি ধাঁধা পছন্দ করতাম। জিগস পাজল, ক্রসওয়ার্ড পাজল, সুডোকু- সব ধরনের ধাঁধা। আমার তো মনে হয়, বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার আগে একজনকে মৌলিকভাবে ধাঁধা সমাধানকারী হিসেবে পটু হতে হবে। টুকরোগুলো একত্র করা, প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করা বা বড় ছবি দেখার চেষ্টা করা- এসব দক্ষতা খুব দরকার।
আমি যখন কলেজে উঠলাম, তখন বুঝতে পারলাম, গণিত ও বিজ্ঞানে আমি আগ্রহী। আমি এমআইটিতে যেতে চেয়েছিলাম। মানে, আমি স্বপ্ন নিয়েই সেদিকে ধাবিত হচ্ছিলাম। আমি কলেজে পড়েছি গণিতকে প্রধান বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু মহাশূন্য নিয়ে আমার অনেক চিন্তাভাবনা ছিল। মহাকাশের ভাবনা কত রাত যে আমাকে জাগিয়ে রাখত। মহাকাশের কী বিশালতা। আর আমরা কত ক্ষুদ্র, কত তুচ্ছ। মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশ ও কাল এত নগণ্য। ভাবলেই ভড়কে যাই, আবার ভাবলে রোমাঞ্চিত হই। আমার মনে হয়, আমি যখন ছোচ ছিলাম, এই দুটি দিকই আমাকে [বিজ্ঞানের পথে] তাড়িত করেছিল।
বলতে পারেন, আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম। আমার জীবনে গর্ব করার মতো বেশ কয়েকজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। একেককজন একেক কারণে আমার কাছে আদর্শ অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সবার আগে মা-বাবার কথা বলতে চাই। তারা ছিলেন মহৎ, অবশ্যই অনুসরণীয়। বাবা অধ্যাপক ছিলেন, সে সুবাদে বিদ্যায়তনিক জগতের ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম প্রথম থেকেই। একজন অধ্যাপকের জীবন কেমন, কী অনুভূতি তাকে জাগিয়ে রাখে- বাবাকে দেখে আমি অনুভব করতে পারতাম। তিনি সব সময় আমার কৌতূহলকে উৎসাহিত করতেন।
আর আমার মা ছিলেন সমসাময়িক এক চিত্রশালার পরিচালক। ফলে নারীরা ঘরের বাইরে যাবে, নেতৃত্ব দেবে- এসব আমি ছোটবেলা থেকেই শিখেছিলাম। আমার সামনে মা ছিলেন সাক্ষাৎ দৃষ্টান্ত।
আমার এক কাকা ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী। আমার এখনো মনে পড়ে, খাবার টেবিলে কাকা ও বাবার সঙ্গে বসে থাকতাম, তারা আলোচনা করতেন- আদি গ্রিকরা কীভাবে সব কিছু শিখেছিল, তারা কীভাবে সমস্যার সমাধান বের করতে জেনেছিল। আদিকালে কোনো কিছু বোঝার প্রক্রিয়া এবং গ্রিকদের আবিষ্কারের সৌন্দর্য বা তাদের যুক্তির নান্দনিকতা আমাকে অভিভূত করেছিল। এজন্য আমি বলব, কাকা আমার শৈশবের একজন অন্যতম বড় আদর্শ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কয়েকজন শিক্ষকের কথা স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে। আমার শিক্ষাজীবনের শুরুর দিকে রসায়ন যার কাছে শিখেছি, সেই শিক্ষিকা আমাকে খুবই উৎসাহ জোগাতেন। একার্থে আমি তো বলব, আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম। কারণ শিক্ষাজীবনের পরবর্তী ধাপে আমি খুব বেশি নারী বিজ্ঞান শিক্ষক পাইনি। ওই শিক্ষিকাই ছিলেন আমার জীবনের অন্যতম প্রেরণাদায়ী ও উৎসাহ জোগানো ব্যক্তিত্ব। আমি প্রায়ই আমার শিক্ষার্থীদের বলি, স্কুল-কলেজে তোমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করো, তা নির্ভর করে তোমাদের শিক্ষাগুরু কে ছিলেন বা কার সঙ্গে তুমি কাজ করো, তাদের গুণাবলির ওপর; তোমাদের পেশাজীবনের বিকাশে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তুমি নিশ্চয়ই এমন মানুষের সঙ্গে কাজ করতে চাও, যিনি তোমার জীবনে ছায়া হয়ে থাকেন, যিনি সত্যিই একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তোমার বিকাশকে উৎসাহিত করতে ও লালন করতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে আমি হেল ব্র্যাটের সঙ্গে কাজ করেছি। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কাজ করেছি গেরি নিউগেবুরের সঙ্গে, পাশাপাশি দ্বিতীয় পরামর্শক হিসেবে পেয়েছিলাম অ্যানিলা সার্জেন্টকে। আমি সত্যিই ভাগ্যবান ছিলাম। এরা এমন মানুষ, যারা আশ্চর্যজনকভাবে উৎসাহদাতা ছিলেন। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।
আমি আমার গ্রুপের তরুণ বিজ্ঞানীদের কিংবা অন্য কোথাও তরুণ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটা কথা প্রায়ই বলি। তাদের বলি, কয়েক বছর পরপর তিনটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে, নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিতে।
এক : তুমি কী করতে ভালোবাসো, কিসে তুমি আনন্দ পাও? কী তোমাকে কৌতূহলী করে তোলে?
দুই : তুমি ঠিক কী অন্বেষণ করতে চাও? মন যা চায়, সেই বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চেষ্টা না করা অবধি তুমি বলতে পারো না, তুমি এটা উপভোগ করবে কী করবে না। একটু পর আমার নিজের জীবনের একটা উদাহরণ দেব, যা থেকে আমি এ বিষয়টি শিখেছি।
তিন : তুমি সমাজকে ফিরতি হিসেবে কী সেবা দেবে, কীভাবে অন্যদের জন্য সেই পথ অবারিত করবে যাতে তারা বুঝতে পারে, কিসে তারা আনন্দ পায়? বিজ্ঞদের থেকে তুমি উপকৃত হয়েছ, তুমি কীভাবে অন্যকে উপকৃত করবে?
আমি মনে করি, এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর কয়েক বছর পরপর ঝালিয়ে নেওয়া দরকার। কারণ সময় যত গড়ায়, মানুষ যত বড় হয়, উত্তরগুলো পাল্টে যায়, বদলাতেই থাকে। কোনো বিষয় যা জানা নেই কিংবা যা ভয় জাগায়, তাও যে চেষ্টা করা উচিত- এ বিষয়ে একটি উদাহরণ দিতে চেয়েছিলাম। আমার জীবনের উদাহরণ। আমি মানুষের সামনে কথা বলতে ভয় পেতাম। এখন তো আমি দিব্যি কথা চালিয়ে যেতে পারি, কিন্তু স্কুলে আমি কথা বলতে ভয় পেতাম। এতটাই ভয় পেতাম যে, পোস্টগ্রাজুয়েট পর্যায়ে এমন স্কুল বেছে নিয়েছিলাম, যেখানে আমাকে অন্যদের পড়াতে হবে না। আমার মনে পড়ছে, যখন আমি আমার প্রথম গবেষণার সেমিনারে কথা বলেছিলাম, মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত কাঁপছিল। আমি খুব নার্ভাস ছিলাম।
আমার পিএইচডি উপদেষ্টা গেরি নিউগেবুর তখন বলেছিলেন, ‘দেখো, তোমাকে তো অন্যকে শেখাতে হবে, তাই এই ভয় অতিক্রম করতেই হবে।’ এর পর আমি শিক্ষকতা করেছি। আমি আবিষ্কার করেছি, আমি সত্যিই এটি উপভোগ করেছি। আমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি পদার্থবিদ্যার বুনিয়াদি পাঠ শিক্ষার্থীদের শেখাতে চাই, কারণ এ বিষয়ে খুব কম নারী শিক্ষক ছিলেন। মানে, আমি এমন কিছু বেছি নিয়েছিলাম, যা ছিল আমার পছন্দের। এটা বেশ বড় অভিজ্ঞতা ছিল। আমি মনে করি, গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষকতার প্রতি আমার যে অভিজ্ঞতা আছে, তা বুঝতে পেরেছিলাম।