জীবাণু সংক্রমণ সুরক্ষায় মধু

লাইফস্টাইল


আবহমানকাল ধরে আমাদের দেশে জন্মের পরপরই নবজাতককে মধু খাওয়ানোর রেওয়াজ প্রচলিত। যেকোনো রেওযাজ প্রচলনের পেছনে কিছু না কিছু ভিত্তি মধ্যে। মধুর মধ্যে এমন কিছু ন্যাচারাল এন্টিবায়োটিকস গেছে, যা শিশুর স্পর্শকাতর দেহে জীবাণুনাশক ক্ষমতা তৈরি করে। এই এন্টিবায়োটিকস পূর্ণবয়স্কদের দেহেও সংক্রমণরোধে সক্ষমতা বাড়ায়। তাই যুগ যুগ ধরে রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মধু ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

প্রাচীনতম চিকিৎসাশাস্ত্রে যেমন মধুর ভেষজ গুণের উল্লেখ রয়েছে, তেমনি আজকের সময়ে বৈজ্ঞানিকভাবেও দেহে পুষ্টি ও শক্তি জোগানোর পাশাপাশি মধুর জীবাণুনাশক আশ্চর্য ক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণায় মধুর মধ্যে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে অকার্যকর করার শক্তিশালি ওষুধি উপাদানের সন্ধান মিলেছে। পাশাপাশি দেহের বিভিন্ন ক্ষত দ্রুত নিরাময়েও মধুর কার্যকর ভূমিকা পালনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মধুর ওষুধি গুণাবলী নিয়ে বিভিন্ন বায়োমেডিকেল ও সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত বেশ কিছু গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য আমরা তুলে ধরছি।

আমরা জানি, মধু দেহে পর্যাপ্ত তাপ ও শক্তির জোগান দেয়। পুষ্টিগুণেও এটি অনন্য। গবেষণায় মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়। ফুলের পরাগের মধুতে থাকে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ, ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ০.৫ থেকে ৩.০ শতাংশ সুক্রোজ এবং ৫-১২ শতাংশ মন্টোজ। আরো থাকে ২২ শতাংশ অ্যামাইনো অ্যাসিড, ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ এবং ১১ ভাগ এনকাইম। এতে চর্বি ও প্রোটিন নেই। ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ ক্যালরি। সবচেয়ে বড়কথা হলো, মধুর মধ্যে থাকে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান যা আমাদের দেহের ভেতরে-বাইরে জীবাণুর বিস্তার প্রতিরোধ করে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, মধুর মধ্যে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ভিত্তিক এনজাইম দেহে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল প্রভাব বাড়ায়। এটি শরীরের আভ্যন্তরিণ পিএইচ স্তরকে এতোটাই শক্তিশালি করে তুলে যে, ব্যাকটেরিয়া দেহকোষে বিপজ্জনক কার্যকলাপ চালানোর সুযোগ পায় না। এটি অবশ্য মধুর গুনগতমানের ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিকভাবে আহরণ করা মধু আর কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করা মেডিকেল গ্রেডের মধুতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদানের বেশ কম আছে। ফুলের পরাগের প্রাকৃতিক মধুই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। আর ভেজাল মধু সেবনে উল্টো জীবাণু-সংক্রমণের শঙ্কা বাড়ায়। পুরো জীবনকে ঠেলে দেয় হুমকিতে।

আধুনিক সময়ে দেহে সংক্রামিত ক্ষত নিরাময়ের চিকিৎসায় অযেনমেন্ট বা মলম ব্যবহার করা হয়। প্রাচীনকালে ব্যবহার করা হতো মধু। এই তথ্য পাওয়া গেছে ২৫০০-২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিছু শিলালিপিতে। আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও মধুর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন, শক্তিশালি এন্টিসেপটিক উপাদান। তারা বলছেন, ক্ষত ও ত্বকের চিকিৎসায় মধু প্রয়োগ করা যেতে পারে। কেটে যাওয়া, ছুঁড়ে যাওয়া বা আগুনে পোড়া ত্বকের কোষ দ্রুত পুনর্গঠনে মধু দারুণ সহায়তা করে। এমনকি পাকস্থলিতে আলসারজনিত ক্ষত নিরাময়ের জন্যও মধু সমান কার্যকর। মধুর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান ক্ষত নিরাময়ে নতুন টিস্যু তৈরির গতি বাড়ায়। ক্ষতে জীবাণু সংক্রমন থেকেও মধু দেয় সুরক্ষা। ক্ষতে প্রদাহ তৈরি করা এন্টারোব্যাক্টার অ্যারোজেনস, সালমোনেলা টাইফিমুরিয়াম, এস.অরেয়াস[সহ বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধেও মধু সমান কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। মধুর এন্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ এতটাই প্রবল যে, যে কোন ধরনের ব্যাকটেরিয়া মধুর মধ্যে এক ঘন্টার বেশি টিকে থাকতে পারে না।

সম্প্রতি পেপটিক আলসার এবং গ্যাস্ট্রাইটিস নিরাময় নিয়ে এক গবেষণায় মধু প্রয়োগে জাদুকরি ফল পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, মধুর মধ্যে থাকা যৌগ ফ্ল্যাভোনয়েড ও পলিফেনলে দেহের অভ্যন্তরের খাদ্যনালি ও অন্ত্রের ক্ষতিগ্রস্ত কোষে উদ্দিপক হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি এসব উপদান প্রদাহ-বিরোধী ভূমিকাও পালন করে থাকে। ক্লিনিকাল পরীক্ষায় দেহের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতে মধু প্রয়োগ করা হলে প্রদাহ দ্রুত হ্রাসের লক্ষণ রেকর্ড করা হয়েছে। মধুর মধ্যে পাওয়া গেছে পর্যাপ্ত কপার, লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ। এসব উপাদান রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠনে সহায়তা দিয়ে থাকে। এসব কারণে বাজারের এন্টিবায়োটিকের মলমের বদলে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মধু ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *