সকাল ৯টা ২০ মিনিট। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণ। আইনজীবী, পুলিশ, বিচারপ্রার্থীসহ সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। এমন সময় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) লেখা সাদা রঙের একটি পুলিশ ভ্যানকে অনুসরণ করে আদালত প্রাঙ্গণে এসে থামে মাঝারি সাইজের একটি প্রিজনভ্যান; বডিতে লেখা ‘পুলিশ’-ইঞ্জিন নম্বর ৬২৪৯৩২’। মুহূর্তেই চারপাশের কোলাহল থেমে যায়; নেমে আসে নীরবতা।
ওয়াকিটকি হাতে অন্য গাড়িগুলো থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পুলিশ সদস্যরা। নীল রঙের প্রিজনভ্যান থেকে রাজসিক ভঙ্গিতে নেমে আসেন সুঠামদেহী ফর্সা এক ব্যক্তি। ক্লিনসেভড। হাতে স্বর্ণবর্ণা বহুমূল্য ঘড়ি; পরনে কালো জিন্স প্যান্ট, গায়ে কালো শার্টের ওপর সাদা চেক; পায়ে সাদা কেডস। তার ডান হাত চেপে ধরে পাশে দাঁড়ানো পরিদর্শক পদমর্যাদার এক পুলিশ সদস্যের হাত; অন্য হাতে আধা লিটারের বোতলজাত পানি। তাদের ঘিরে হাঁটছেন আরও দুই পুলিশ সদস্য। সুঠামদেহী ফর্সা লোকটির চালচলনে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে উনি বুঝি পুলিশেরই ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা। হয়তো পেশাগত প্রয়োজনে গোপনীয়তা রক্ষায় প্রিজনভ্যানে চেপে এসেছেন।
মোটেও তা নয়। তিনি এ মহানগরীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের একসময়ের ডন। তিনি শীর্ষসন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন। চিকিৎসক দম্পতির এই সন্তানকে ধরতে দুই হাজার সালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি বিশেষ টিমকে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ওপার বাংলায় পাঠানো হয়েছিল।
ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা এই শীর্ষসন্ত্রাসী সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব) আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু, জাতীয় পার্টির কর্মী মাহমুদ হাসান পলাশ ও চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাসহ দুই ডজনেরও বেশি হত্যা ও অস্ত্র মামলার আসামি। কিন্তু আদালতে উপস্থিত ইমনের চালচলনে মনে হয়েছে, কারাগারে বেশ সুখেই আছেন তিনি। বেশভূষায় ধনাঢ্য ভাব আর বিলাসিতার চাকচিক্য দেখে বিশ্বাস হতে কষ্ট হয়, তার চোখের সামান্য ইশারায় একসময় লাশ পড়ত ঢাকায়। যদিও কালের পরিক্রমায় তিনি এখন কারাবন্দি।
জানা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে একটানা ১৪ বছর ধরে ইমন কারাগারে থাকলেও তার বিরুদ্ধে চলমান সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যাসহ ৩টি আলোচিত হত্যা মামলার বিচার গত দুই যুগেও শেষ হয়নি। বিচার শেষ না হওয়া অপর দুই মামলা জাতীয় পার্টির কর্মী মাহমুদ হাসান পলাশ হত্যা এবং চলচ্চিত্র নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা। মামলাগুলোর মধ্যে টিপু হত্যা মামলার বিচার প্রায় শেষ পর্যায়ে থাকলেও চলচ্চিত্র নায়ক সোহেল চৌধরী হত্যা মামলার বিচার সম্প্রতি শুরু হয়েছে এবং পলাশ হত্যা মামলা সাক্ষী না আসায় শেষ হচ্ছে না। একমাত্র সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা ছাড়া তিনি অপর সব মামলায়ই জামিন রয়েছেন। চলতি বছর ২৯ আগস্ট এ মামলায় হাইকোর্ট এ আসামির জামিন প্রশ্নে রুল জারি করেছেন। ওই মামলায় জামিন পেলেই কারামুক্ত হতে পারবেন তিনি। আলোচিত এই ৩টি হত্যা মামলায় মাসে কমপক্ষে দুবার কারাগার থেকে আদালতে আনা হচ্ছে ইমনকে। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার শুনানিতে অংশ গ্রহণের জন্য গতকাল রবিবার তাকে আনা হয় দায়রা জজ আদালতে। কিন্তু সাক্ষী না আসায় আদালত পরবর্তী শুনানির দিন আগামী ২৪ নভেম্বর ধার্য করেছেন।
শীর্ষসন্ত্রাসীদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় পায়ে ডাণ্ডাবেরি, হাতে হাতকড়া, গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় বুলেটপ্রুফ হেলমেট পরিয়ে আদালতে আনার কথা। কিন্তু গতকাল আদালতে তার কোনো নজির দেখা যায়নি শীর্ষসন্ত্রাসী ইমনের ক্ষেত্রে। অনেকটা জামাই আদর করেই ঢাকা মেট্রোপলিটন জজকোর্টের হাজতখানায় ঢোকানো হয় তাকে। বিষয়টি ঢাকা মেট্রোপলিটন জজকোর্টের হাজতখানায় দায়িত্বরত পরিদর্শক মো. হাকিমের দৃষ্টিগোচরে আনা হলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, এটা হতে পারে না। যদি হয়ও তবে কারাগার থেকে যারা এনেছেন তাদের বিষয় এটি। এরপর হাজতখানায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়টি ছিল লক্ষণীয়। পরে কারাগার থেকে ইমনকে যেই পুলিশ পরিদর্শকের নেতৃত্বে আদালতে আনা হয় তার কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য দূরে থাক নামটিই জানাতে চাননি তিনি।
রবিবার সকাল ১০টা ৩৪ মিনিটে ঢাকা মেট্রোপলিটন জজকোর্টের হাজতখানা থেকে তৃতীয় তলায় অবস্থিত বিচারকের এজলাস কক্ষে নেওয়া হয় ইমনকে। এই পথটুকু যেতে চরম নাটকীয়তার অবতারণা ঘটে সিঁড়িতে। ঢাকা মেট্রোপলিটন জজকোর্টের হাজতখানা থেকে ইমনের গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট পরিয়ে বের করতে দেখা গেলেও এক মিনিট না যেতেই দোতলার সিঁড়িতে নিজ হাতে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথার হেলমেট খুলে ফেলে তা ছুড়ে মারেন পাশেই থাকা এক পুলিশ সদস্যের (কনস্টেবল) দিকে। হাতে হাতকড়ার বালাই ছিল না। এভাবেই বীরদর্পে সম্পূর্ণ উন্মুক্তভাবে এজলাস কক্ষে প্রবেশ করেন শীর্ষসন্ত্রাসী ইমন।
এজলাস চত্বরেও নাটকীয়তা মোড় নেয়। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকা-ে অভিযুক্ত আরও দুজনেরও শুনানি ছিল গতকাল। তারা এজলাসে আসতে একটু দেরি করছিলেন। তাই পাশেই উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের ধমক দিয়ে শীর্ষসন্ত্রাসী ইমন ওই দুজকে তাড়াতাড়ি এজলাস কক্ষে আনতে হুকুম করেন। শুনানি শেষে ১০টা ৪৪ মিনিটে একইভাবে সম্পূর্ণ উন্মুক্তভাবে ফের ঢাকা মেট্রোপলিটন জজকোর্টের হাজতখানায় ঢোকানো হয় ইমনকে। সেখানে দুপুর ১২টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ছিলেন। ভেতরে কী হয়েছিল জানা যায়নি। তবে বাইরে থেকে বেশ কয়েকজন বহিরাহত এবং পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন ব্যাগে ভারী কিছু নিয়ে যেতে দেখা যায় হাজতখানায়। দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে তাকে হাজতখানা থেকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট পরিয়ে বের করতে দেখা গেলেও সেখানেও নাটকের জন্ম দেন ইমন। এবারও মিনিট না যেতেই আদালত প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যেই পুলিশের সামনে নিজ হাতে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথার হেলমেট খুলে ফেলে তা ছুড়ে মারেন পাশেই থাকা অন্য পুলিশ সদস্যের (কনস্টেবল) দিকে। সম্পূর্ণ উন্মুক্তভাবে এগিয়ে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ফিল্মিস্টাইলে বাংলাদেশ পুলিশ লেখা মাঝারি সাইজের সেই প্রিজনভ্যানে উঠে পড়েন সুঠামদেহী ইমন। এবার ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) লেখা সাদা রঙের ওই পুলিশভ্যানটি অনুসরণ করছিল সামনেই থাকা প্রিজনভ্যানটি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মূল সড়ক ধরে এগোতে থাকে দুটি ভ্যান।