সরবরাহের ঘাটতি দেখিয়ে বাজারে লাগামহীন আটা ও চিনির দাম। ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতির পরেও চিনির বাজারে অস্থিরতা কমেনি, উল্টো বেড়েছে। আবার অনেক দোকানে চিনি পাওয়াও যাচ্ছে না। কয়েকদিনের ব্যবধানে খোলা আটার দাম বেড়ে ৬৪ টাকায় ঠেকেছে। কিছু দিন আগেও ৫৫ টাকায় পণ্যটি কেনা গেছে।
বাজারে মোটা চালের কেজি ৪৮ থেকে ৫০ টাকা এবং মাঝারি চালের কেজি ৫৬ থেকে ৬২ টাকা। অর্থাৎ খোলা আটার দাম মোটা ও মাঝারি চালের দামকেও ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে প্যাকেট আটার দামও কোম্পানিগুলো হুটহাট বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।
রাজধানীর মালিবাগ বাজারের ভুইয়া স্টোরের ব্যবসায়ী মো. শিপন জানান, এ বাজারে নামিদামি ব্র্যান্ডের ভালোমানের খোলা আটার কেজি এখন ৬২ থেকে ৬৪ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। আর সাধারণ মানের আটা ৬০ থেকে ৬২ টাকা।
একই বাজারের বিপ্লব স্টোরের ব্যবসায়ী মো. সোলেয়মান জানান, প্যাকেট আটার দামও রাতারাতি বাড়িয়ে দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। দুই কেজির প্যাকেট আটা কোম্পানিভেদে ১২৫ টাকা ১৩০ টাকা বিক্রি করছি। গত সপ্তাহে ছিল ১২০ টাকা। এর আগে ১১৫ টাকায় বিক্রি করেছি। এখানেই শেষ নয়, ডিলাররা জানিয়েছেন কিছুদিনের মধ্যে দাম আরও বাড়বে।
সোলায়মান ও গাজী স্টোরের মো. রুবেল হোসেনসহ এ বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, চিনির বাজারের অস্থিরতা কমেনি। এ বাজারে খোলা চিনি ১১০ থেকে ১১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। চিনি চেয়েও কোম্পানির কাছ থেক সরবরাহ মিলছে না। পাইকারি বাজারেও চিনির সরবরাহ কম দেখিয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে রাজধানীর অন্যন্য বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও কোথাও ১২০ টাকা কেজি দরেও খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে। কদমতলী সাদ্দাম মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. মিলন জানান, পাইকারিতে চিনির বস্তা (৫০ কেজি) কিনতে হচ্ছে ৫ হাজার ৪০০ থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকায়। তার সঙ্গে পরিবহন খরচ ও শ্রমিক খরচ রয়েছে। এ চিনি ১২০ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়।
মৌলভীবাজারের পাইকারি বাজারের মো. শাজাহান মোল্লা জানান, পাইকারিতে আগের মতো চিনির সরবরাহ না থাকলেও ততটা সংকট নেই। কিন্তু দাম অনেক বাড়তি। বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে বলে আমাদের বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। আমরা নিরুপায়।
এদিকে অনেক দোকানে এখনো চিনি বিক্রি হচ্ছে না। কারণ জানতে চাইলে বিউটি স্টোরের জাকির হোসেনসহ কারওয়ানবাজারের কিচেন মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ৫০০০ টাকার বস্তার চিনি যেটুকু ছিল, তা ১০৫ টাকা দরে বিক্রি শেষ। এখন পাইকারিতে দাম অত্যধিক বেড়েছে এবং বস্তার সঙ্গে ক্রয় রসিদ দিচ্ছেন না পাইকাররা। রসিদ ছাড়া এত চড়া দামে চিনি বিক্রি করলে মোবাইল কোর্টে জরিমানা গুনতে হতে পারে। তাই এখানকার অনেক খুচরা ব্যবসায়ী চিনি বিক্রি বন্ধ রেখেছেন।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকালের বাজার প্রতিবেদন বলছে, রাজধানীতে খোলা আটার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৩ টাকায়। এক মাস আগে যা বিক্রি হয় ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায়। আর এক বছর আগে এ দাম ছিল ৩৩ থেকে ৩৬ টাকা। সংস্থাটির হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খোলা আটার দাম ৭৮ দশমিক ২৬ শতাংশ বেড়েছে। অপরদিকে খোলা চিনি নিয়ে টিসিবি পর্যবেক্ষণ বলছে, চিনির বর্তমান মূল্য ১১০ থেকে ১১৫ টাকা কেজি। এক মাস আগে যা ৯০ থেকে ৯৫ টাকা এবং এক বছর আগে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় কেনা গেছে। এ হিসাব অনুযায়ী বছরের ব্যবধানে পণ্যটির দাম ৪৫ শতাংশ বেড়েছে।
বছরের ব্যবধানে পণ্য দুটির দাম এত হারে বৃদ্ধি দেখে হতবাগ বেশির ভাগ ভোক্তা। বাসাবো এলাকার বাসিন্দা পোশাক কারখানা শ্রমিক মো. তানভির বলেন, ভাতের ওপর চাপ কমাতে প্রায়ই রুটি খেতাম। এখন চালের চেয়ে আটার দাম বেশি। অল্প সময়ে দাম অস্বাভাবিকভাবে এত বেড়ে যাচ্ছে, অথচ কেউ যেন দেখার নেই। আমরা ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে আছি।
এর আগেও চিনির বাজারে অস্থিরতা ও সংকট দেখা দিলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বৈঠকে জানানো হয়, দেশের চিনি পরিশোধন কারখানাগুলোতে অপরিশোধিত চিনির ঘাটতি নেই। আগামী তিন মাস চলার মতো চিনির মজুদ আছে। সরকারের তরফ থেকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে পরিশোধিত চিনি পেতে সমস্যা হবে না। চিনি কারখানাগুলোর মালিকরাও আশ্বাস দিয়েছিলেন, শিগগিরিই চিনির সংকট কেটে যাবে- সরকার নির্ধারিত দামেই পাওয়া যাবে চিনি। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাজারে পণ্যটির সরবরাহ বাড়েনি; দামও কমেনি। উল্টো বেড়েছে।
বাজারে চিনি ও আটার সরবরাহ যাচাইয়ে ভোক্তা অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে বলে জানান সংস্থাটির পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, নিয়মিত বাজার তদারকির পাশাপাশি চিনি ও আটাতে বিশেষ নজর রয়েছে আমাদের। আমরা পণ্য দুটির সরবরাহ খতিয়ে দেখছি। তবে আগের চেয়ে এগুলোর সরবরাহ বেড়েছে। তার পরও সরবরাহে কোনো কারসাজি হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে আটা ও চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপত্তিতে পড়েছে রাজধানীর বেকারিগুলো। বেকারি মালিকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট অ্যান্ড কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, আটা-চিনির দাম এতটাই বেড়েছে যে বেকারি পণ্যের দাম না বাড়িয়ে আমাদের উপায় নেই। আলোচনা চলছে, খুব শিগগিরিই হয়তো পাউরুটি, বিস্কুট, কেকসহ বেকারি পণ্যের দাম বাড়ানো হতে পারে।
বেশ কয়েকজন টং দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় চায়ের ব্যবসায় লাভ অনেক কমে গেছে। তারাও প্রতিকাপ চায়ের দাম ১ থেকে ২ টাকা বাড়ানোর কথা ভাবছেন। অনেকে ইতোমধ্যেই দাম বাড়িয়েও দিয়েছেন।