বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের মতো চাকরিকাল ২৫ বছর পার হওয়া কট্টর ভিন্নমতের কর্মকর্তাদের বর্তমান সরকারও একের পর এক অবসরে পাঠাচ্ছে। গতকাল পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। কিছুদিন আগে আরও তিন পুলিশ কর্মকর্তা এবং এক সচিবকে অবসরে পাঠানো হয়। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর এই তালিকায় আরও সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন। যাদেরকে ধাপে ধাপে অবসরে পাঠানো হবে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র বলছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না সরকার। যে কারণে নির্বাচনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কট্টর ভিন্নমতের কর্মকর্তাদের পর্যায়ক্রমে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর অলিখিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, পুলিশ ক্যাডারের ৮ম, ১২তম ও ১৫ ব্যাচের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা বাধ্যতামূলক অবসর ঝুঁকিতে রয়েছেন। এসব ব্যাচের কর্মকর্তারা অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতি পেলেও রাজনৈতিক আদর্শের কারণে অনেকেই এসপি ও অতিরিক্ত ডিআইজির পর দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত। গতকাল সোমবার পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। গত ১৮ অক্টোবর সিআইডির দুজনসহ ৩ পুলিশ সুপারকে অবসর দেয় সরকার।
একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা জানা গেছে, গত ১৩ দিনে ৫ পুলিশ কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। ১৮ অক্টোবর তিন এসপিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালেও গতকাল দুজন অতিরিক্ত ডিআইজিকে অবসরে পাঠানো হলো। তারা সবাই পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তা। তাদের ব্যাচের কর্মকর্তারা এখন অতিরিক্ত আইজিপি পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছেন। তিন ব্যাচের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তা রয়েছেন ১৫ ব্যাচের। এ ব্যাচের এসপি পদে অন্তত ২৫ জন কর্মকর্তা রয়েছেন যারা দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত। ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর এই ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগদান করেন। সে সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় ছিল। তাই রাজনৈতিক আদর্শের কারণে এই ব্যাচের বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়নি। ১২তম ও ৮ম ব্যাচের কর্মকর্তাও রয়েছেন যাদের এসপি হওয়ার পর আর পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। এসব ব্যাচের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদারও কিছু কর্মকর্তাও দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত। তাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পার হয়েছে।
জানা গেছে, পুলিশের ক্ষেত্রে ২৭তম ব্যাচ পর্যন্ত পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তার সংখ্যা ২২৫ জনের মতো। যাদের অধিকাংশেরই রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে পদোন্নতি হয়নি। তবে চাকরির বয়স ২৫ বছর না হওয়ায় এসব কর্মকর্তা অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত।
সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, রাজনৈতিক কারণে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে দীর্ঘদিন ধরে সরকার পদোন্নতি দিচ্ছে না। এসব কর্মকর্তার পেছনে প্রতি মাসে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ভালো পদায়নেও নেই। অনেক কর্মকর্তারা শুধু রুটিন করে অফিসে যান। তিন পুলিশ সুপারের অবসরের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী প্রচারণা, ঠিকমতো অফিস না করার অভিযোগ আছে।
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিষয়টি প্রশাসনের জন্য খারাপ নজির উল্লেখ করে একাধিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, কোনো কর্মকর্তা অদক্ষ হলে, অপরাধ করলে কিংবা দায়িত্ব পালন না করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে হবে। এরপর আইন অনুযায়ী বিচার হবে। বিচার না করে সব সুবিধা দিয়ে এভাবে চাকচি্যুত করা হলে তা প্রশাসনের জন্য খারাপ নজির হয়ে থাকবে।
সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ (পঁচিশ) বৎসর পূর্ণ হইবার পর যে কোনো সময় সরকার, জনস্বার্থে, প্রয়োজনীয় মনে করিলে কোনোরূপ কারণ না দর্শাইয়া তাহাকে চাকরি হইতে অবসর প্রদান করিতে পারিবে।’ এই ধারায় আরও বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, যে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন গ্রহণ করিতে হইবে।’
দুই কর্মকর্তা বাধ্যতামূলক অবসরে : বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তাকে গতকাল সোমবার বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। অবসর পাওয়া কর্মকর্তারা হলেন-সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মো. আলমগীর ও টুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মো. মাহবুব হাকিম।
সোমবার রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আমিনুল ইসলাম খান স্বাক্ষরিত পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপনে তাদেরকে অবসরে পাঠানোর কথা জানানো হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরি ২০১৮ (২০১৮ সালের ৫৭ নং আইন)-এর ৪৫ ধারার বিধান অনুযায়ী জনস্বার্থে তাদেরকে সরকারি চাকরি থেকে অবসর প্রদান করা হলো। জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ কার্যকর হবে।
এর আগে বাধ্যতামূলক সিআইডির দুজনসহ ৩ পুলিশ সুপারকে অবসর দেয় সরকার। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের সদস্য ঢাকার অপরাধ তদন্ত বিভাগের পুলিশ সুপার মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী ও দেলোয়ার হোসেন মিঞা এবং ঢাকা পুলিশ অধিদপ্তরের পুলিশ সুপার (টিআর) শহীদুল্ল্যাহ চৌধুরী। অবসরপ্রাপ্ত এ তিন পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে মুহাম্মদ শহীদুল্ল্যাহ চৌধুরী ও দেলোয়ার হোসেন মিঞা বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ১২তম ব্যাচের। আর মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এ তিন কর্মকর্তার মধ্যে ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে মুহাম্মদ শহীদুল্ল্যাহ চৌধুরী পিপিএম এবং মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী পিপিএম (সেবা) পদকপ্রাপ্ত।