এক বছরে কমেছে ১০.২১ বিলিয়ন নভেম্বরে আকুর পেমেন্টের পর ৩৪ বিলিয়নে নামার আশঙ্কা আগের পদক্ষেপগুলো মূল্যায়ন করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ
জিয়াদুল ইসলাম
আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অব্যাহতভাবে কমে যাচ্ছে। এর ফলে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। সর্বশেষ গত বুধবার রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। ওইদিন রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। এটি গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন । গত এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে গত দেড় মাসেই কমেছে ৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রিজার্ভ যে গতিতে কমছে তা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ। তাই রিজার্ভ সাশ্রয়ে নেওয়া পদক্ষেপগুলো কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, তা দ্রুত মূল্যায়ন করে নতুন করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় হওয়ার কারণে বাধ্য হয়েই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এতে প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে রিজার্ভ। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার মূল্যের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ আমাদের সময়কে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে টানা ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ কমেছে। তবে এর মধ্যেও স্বস্তির খবর হলো সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে আমদানিতে নতুন এলসি খোলা কমে এসেছে। আন্তঃব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারের ডলারের দামের ব্যবধানও কমে এসেছে। ফলে আগামীতে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়বে। একই সঙ্গে রপ্তানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি বজায় থাকলে সংকট কিছুটা কাটতে পারে।
জানা গেছে, বিলাসীপণ্য আমদানিতে শতভাগ এলসি মার্জিনের শর্তারোপের পর জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে আমদানির জন্য এলসি খোলা কিছুটা কমেছে। তবে আগের বকেয়া আমদানির এলসি নিষ্পত্তির জন্য অনেক ব্যাংকেই ডলারের সংকট আছে। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করতে হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি উন্নতির পর বিদেশ ভ্রমণ ও চিকিৎসা খাতে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বেড়েছে। এতে ডলারের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। এ সংকট মেটাতে এবং টাকা ও ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। বিশেষ করে সরকারের বিভিন্ন আমদানিতে সংকট হলেই রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গতকালও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ৬ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস ২০ দিনে (১ জুলাই থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত) রিজার্ভ থেকে ৪৫৮ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এই হারে যদি ডলার বিক্রি করা হয়, তা হলে অর্থবছর শেষে ডলার বিক্রির নতুন রেকর্ড করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ ব্যাপক চাহিদার পরও গত অর্থবছরের পুরো সময়ে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। যদিও বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত বেশি ডলার বিক্রি করা হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, যে রিজার্ভের কথা বলা হচ্ছে, ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ তার চেয়ে অনেক কম। এর মধ্যেই চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে ফেলা হয়েছে। প্রতি মাসে যদি ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়, তাহলে সেটা তো উদ্বেগের কারণই। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বড় একটা অংশ চলতি অর্থবছরের মধ্যে পরিশোধের একটা চাপও আসবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ৫৫০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়া গেলে কয়েক মাস হয়তো স্বস্তিতে থাকা যাবে। কিন্তু তার আগেই আমাদের মৌলিক জায়গায় হাত দিতে হবে। বিশেষ করে রিজার্ভ সাশ্রয়ে এ পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে তাও মুল্যায়ন করে দেখা দরকার। যদি সাশ্রয়ের চেয়ে আয়ের প্রভাবটা বেশি নেতিবাচক হয়, তাহলে তো কোনো লাভ হলো না, উল্টো হিতে বিপরীতে হয়ে যাবে।
গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বৈদেশিক মুদ্রার কেনাবেচনার যে নতুন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেখানে একই মুদ্রার নানা রকম দর নির্ধারণ করা হয়েছে। কেনার ক্ষেত্রে চারটি দর আছে। এগুলো হলো রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে ভিন্ন ভিন্ন দর। আবার ব্যাংকিং চ্যানেলে এলে একটা দর, মানিচেঞ্জারদের মাধ্যমে এলে আরেকটা দর। আবার বিক্রির ক্ষেত্রে দুটি দর। এগুলো হলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রির একটি দর। আবার আন্তঃব্যাংকে ডলার বিক্রির দর আরেকটি।
এভাবে বৈদেশিক মুদ্রার এই ভিন্ন ভিন্ন দর ডলারের জোগান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে বলেও মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, কেনার ক্ষেত্রে নানা রকম দামের কারণে ডলার বিক্রির দর সব ব্যাংকের জন্য একই থাকছে না। আমাদের ৫৬টি ডিলার ব্যাংক আছে, ফলে বিক্রির দরও ৫৬টিতে উন্নীত হয়েছে। আর কোনো মুদ্রার এতগুলো দর থাকলে, সেই মুদ্রার জোগান কঠিন হয়ে যায়, বিশেষ করে আনুষ্ঠানিক পথের জোগানগুলো। কাজেই যত দিন ইউনিফর্ম এক্সচেঞ্জ রেটের (একক বিনিময়মূল্য) দিকে যাওয়া সম্ভব হবে না, তত দিন সমস্যা আরও প্রকট হবে। তাই মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাপনায় বহুমুখী হার থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইউনিফর্ম এক্সচেঞ্জ রেট চলে আসবে।
মহামারী করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময়ে আমদানিতে ধীরগতি এবং প্রবাসী আয়ে উড়ন্ত গতির ওপর ভর করে গত বছরের ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ প্রথমবার ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, যা ছিল অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এরপর থেকে রিজার্ভের পরিমাণ কমতে শুরু করে। সর্বশেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর আকুর ১ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। ওইদিন রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলারে। এরপর থেকে রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই অবস্থান করছিল। তবে রিজার্ভ থেকে টানা ডলার বিক্রির চাপে গত বুধবার তা ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যায়। গতকাল দিনশেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। যদিও ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ আরও কম।
এদিকে আসছে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই আকুর দেনা বাবদ আরও প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার কথা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এটা পরিশোধ করার পর রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে, তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।
ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে বেশ কয়েক মাস ধরেই। বেড়ে চলেছে মার্কিন ডলারের দামও। ফলে ক্রমশ কমছে টাকার মান। গতকাল আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম ছিল ১০৫ টাকা। আর খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হয় ১০৮ থেকে ১০৯ টাকায়। অবশ্য কিছুদিন আগে খোলাবাজার ডলারের দর ১২০ টাকায় উঠেছিল। তখন ব্যাংকেও নগদ ডলারের দাম ১১৫ টাকা ছাড়িয়ে যায়।