৭০শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত বর্জ্য ভয়াবহ দূষণের কবলে শীতলক্ষ্যা

Slider অর্থ ও বাণিজ্য কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি গ্রাম বাংলা জাতীয় টপ নিউজ ঢাকা সারাদেশ সারাবিশ্ব

sitolakha
গ্রাম বাংলা ডেস্ক:  ভয়াবহ দূষণ আর দখলের কবলে পড়েছে শীতলক্ষ্যা নদী। এক সময় এ নদীর পানি বোতলজাত হয়ে বিদেশে যেতে । অথচ এখন এ নদীর পানি ব্যবহার করা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীর পানি সায়েদাবাদ এবং গোদনাইল পানি শোধানাগারের মাধ্যম্যে শোধন  করার পরও তা থেকে বেরিয়ে আসে উৎকট গন্ধ। শীতলক্ষ্যার পানি দূষণের কারণে এমনটি হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র জানায়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি নদীদূষণকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের সৈয়দপুর থেকে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া পর্যন্ত ছোট বড় ৭০টি শিল্প প্রতিষ্ঠনের বিষাক্ত  বর্জ্য শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে মিশছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শীতলক্ষ্যা দূষণের জন্য দায়ী শিল্প-কারখানার বেশির ভাগেরই বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নেই। বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ইটিপি থাকলেও অনেক সময়ই তা বন্ধ থাকে। এতে পরিশোধন ছাড়াই শিল্পবর্জ্য গিয়ে মিশছে শীতলক্ষ্যার পানিতে। নদীটি ঘিরে এমন অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। আবার যেসব কারখানার অবস্থান নদী থেকে দূরে, বর্জ্যনিষ্কাশন কাজে তারা ব্যবহার করছে পৌর ও সিটি করপোরেশনের নর্দমা। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যও মিশছে শীতলক্ষ্যায়।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্ট তাদের পরীক্ষায় দেখিয়েছে, কাঁচপুর খাল এলাকায় শীতলক্ষ্যার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে দশমিক ১৮ মিলিগ্রাম। কাঁচপুর বিআইডব্লিউটিএ টার্মিনাল এলাকায় এর মাত্রা দশমিক ১৯ মিলিগ্রাম, সাইলো এলাকায় দশমিক ১২, সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে দশমিক ১৯, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কাছে দশমিক ৫১, পদ্মা পেট্রোলিয়াম এলাকায় দশমিক ৪২ ও আকিজ সিমেন্ট কারখানার পাশে দশমিক ৭৪ মিলিগ্রাম। এছাড়া শীতলক্ষ্যার সিনহা টেক্সটাইল এলাকায় দশমিক শূন্য ২, স্ক্যান সিমেন্টের কারখানার পাশে দশমিক শূন্য ৮, পুষ্টি ভোজ্যতেল কারখানার পাশে দশমিক শূন্য ৩ ও ওয়াসা ইনটেক এলাকায় প্রতি লিটারে দ্রবীভূত অক্সিজেন পাওয়া গেছে দশমিক শূন্য ৪ মিলিগ্রাম। যদিও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০০৭ অনুযায়ী, মৎস্য ও জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকার কথা ৫ মিলিগ্রামের বেশি।

এছাড়া শীতলক্ষ্যার পানিতে ক্ষারের পরিমাণও বেশি বলে পবা ও ডব্লিউবিবির পরীক্ষায় উঠে এসেছে। প্রতি লিটার পানিতে এর গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৭ পিএইচ ও এর কাছাকাছি হলেও শীতলক্ষ্যার প্রতিটি পয়েন্টেই এর মাত্রা ৮-এর বেশি।

শীতলক্ষ্যা দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম এসেছে নারায়ণগঞ্জ সল্ট, আজিমুদ্দিন ভূঁইয়া ট্রাস্ট, জামাল সোপ ফ্যাক্টরি, আমিন ব্রাদার্স জুট এন্ড কোং, প্যারিটি ফ্যাশন, পিএন কম্পোজিট, ইব্রাহিম নিটেক্স, সানি নিটিং, নিট কনসার্ন, ফ্লক প্রিন্ট, সিদ্দিক ফুড, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল, রেক্স নিট ওয়ার্ক, আরএজেড নিট ওয়ার্ক, সোহাগপুর টেক্সটাইল মিলস ও প্রিতম ফ্যাশনেরও। এ তালিকায় আরো আছে শিউল টাওয়েল ফ্যাক্টরি, ইব্রাহিম টেক্সটাইল, স্টার পার্টিকেল বোর্ড, আম্পর পাল পেপার মিল, কনিক পেপার মিল, মালেক জুট মিলস, কাঁচপুর ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, জয়া গ্রুপ ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, বেঙ্গল প্যাকেজেস, সোনালি পেপার মিলস, রহমান কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, শবনম ভেজিটেবল অয়েল মিলস, ক্রিস্টাল সল্ট, লিনা পেপার মিলস, অনন্ত পেপার মিলস ও জালাল জুট বলিং এন্ড কোং। এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু অংশের বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি থাকলেও তা বন্ধ রাখা হচ্ছে।

এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, শীতলক্ষ্যার তীরে গড়ে উঠা এসিআই লিমিটেডের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসিআই ফ্লাওয়ার মিল ও এসিআই সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শিল্পবর্জ্যে শীতলক্ষ্যা প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। পিছিয়ে নেই বেক্সিমকো গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান নিউ ঢাকা ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেডও। শিল্পের বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে নদীদূষণ করছে সিটি গ্রুপ, আকিজ সিমেন্ট, সিনহা টেক্সটাইল, আদমজী ইপিজেড, শাহ সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, মেট্রোপলিটন সিমেন্ট, সুপার সল্ট, এসডি ফ্লাওয়ার মিল, পূবালী সল্ট, উত্তরা লবণ ও পপুলার জুট এক্সচেঞ্জও।

সূত্র জানায় শিল্প-কারখানাই শুধু নয়, ছোট বড় ২২টি পাইপলাইন দিয়ে কদমরসুল ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দূষিত পানি শীতলক্ষ্যায় ফেলা হচ্ছে। নদীতীরবর্তী এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও নদীদূষণ করে চলেছেন। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তৈরি তালিকায়ও তা উঠে এসেছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. আনিছুর রহমান মিঞা গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, নদী রক্ষায় অভিযান চালানো একটি নিয়মিত কার্যক্রম। হাইকোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে, তা অনুসরণ করা হয় এক্ষেত্রে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তালিকা তৈরিতে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা ছিল। প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এর পর নিয়ম অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতলক্ষ্যা রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ না নিলেও ভবিষ্যতে এর পরিণতিও হবে বুড়িগঙ্গার মতো ভয়াবহ। বর্তমানে বুড়িগঙ্গায় যেমন জীববৈচিত্র্য নেই, একই অবস্থা হবে শীতলক্ষ্যারও।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ শামচ্ছুদ্দোহা খন্দকার জানান, ঢাকা ও এর চারপাশের ১১৯ কিলোমিটার নদীকে আগের অবস্থানে নিয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন, নদী দখল ও দূষণ রোধে সরকার আন্তরিক। এ বিষয়ে নদীদূষণ ও দখলকারীদের সময় বেঁধে দেয়া হবে। সময়ের মধ্যে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ব্যবস্থা না নেয়, তবে এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, জরিমানা করেও নদীতে বর্জ্য ফেলা থেকে শিল্প মালিকদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। এবার নদী রক্ষায় দূষণের উৎসস্থলগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দূষণের সঙ্গে জড়িতদের একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। শিল্প, নৌ-পরিবহন, বন ও পরিবেশসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের কাছে তালিকাটি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে টাস্কফোর্স যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।

গণমাধ্যমকে বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, শীতলক্ষ্যায় শিল্পবর্জ্য ফেলা বন্ধ করা যায়। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা না নিয়ে কোনো কিছু করতে গেলে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবে। তবে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যাবতীয় দূষণ রোধে দেড় বছরের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমন ব্যবস্থা করা হবে, যাতে সবাই ইটিপি চালু রাখতে বাধ্য হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *