কীভাবে হয়েছিল প্রতিবাদ?

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সেদিনই ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ হলেও ঢাকায় প্রকাশ্য প্রতিবাদ হতে সময় লেগেছে প্রায় দুই মাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া, সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ভীতি ছড়ানোর মধ্য দিয়ে হতবিহ্বল মানুষ নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করে মাঠে নেমেছিল ২০ অক্টোবর।

তবে সে সময়েও একেবারেই যে প্রতিবাদ হয়নি বা মানুষ প্রতিবাদ করেনি বলা হচ্ছে, সেটা ঘাতকদের মিথ্যা প্রচারণা বলেন অনেক গবেষক। আবার অনেক বেশি প্রতিবাদ দেখা গেছে এমনও নয়। মুজিব হত্যার প্রতিবাদ জানাতে তখন সক্রিয় ছিলেন সে সময়ের ছাত্রনেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূর-উল-আলম লেনিন, কাজী আকরাম হোসেন, মাহবুব জামান, বাহলুল মজনুন চুন্নু, মৃণাল সরকার, রবিউল আলম মুক্তাদির, ইসমত কাদির গামা, খন্দকার শওকত হোসেন, মমতাজ হোসেন, কাজল ব্যানার্জি প্রমুখ।

প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সিপিবির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের বছর ১৯৭৬ সালের ১৭ মার্চ ছাত্র ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ একটি লিফলেট ছাপায়। পুরো সময়টা তারা নানা লিফলেট প্রকাশের মাধ্যমে অল্প অল্প করে সত্য প্রকাশ করতে থাকে।

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজকদের একজন ছিলেন বর্তমানে অনলাইন পোর্টাল বাংলাদেশ জার্নালের সম্পাদক শাজাহান সরদার। কখন জানলেন বঙ্গবন্ধু নেই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পরদিন ভোরে আমাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে বের হই। বঙ্গবন্ধু আসবেন ক্যাম্পাসে, কাজ ভাগাভাগি করা আছে। আমি হলের বাইরে চায়ের দোকানে গিয়ে নিজ কানে শুনতে পাই—বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর। সে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি। পুলিশ সদর দফতরের পাশে ছিল রেল কলোনি। সেখানে গিয়ে থাকি সেদিন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা যায়, এটা কারোর কাছে বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। কিন্তু সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।’

অজয় দাশগুপ্ত মনে করেন, ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড ও বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হাজারো রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের পর প্রতিবাদ সহজ ছিল না। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যারা রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন, তারাই প্রতিবাদ সংঘটিত হতে দেননি। জাতীয় ছাত্রলীগের ব্যানারে ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে প্রতিবাদ মিছিল বের হলে এতে হামলা চালিয়েছিল ওই অপশক্তিই।

অজয় দাসগুপ্ত বলেন, ২০ অক্টোবর থেকে অল্প অল্প করে প্রতিবাদ সামনে আসতে শুরু করে। ৪ নভেম্বর সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার ছাত্র প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যায়৷ সেখানে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের জন্য গায়েবানা জানাজা পড়া হয়। করা হয় প্রতিবাদ সমাবেশ।

তিনি জানান, তারা মিছিল করে যাওয়ার সময় রাস্তায় সেনা সদস্য এবং ট্যাংকের টহল দেখতে পান। ফিরে আসার পথে জানতে পারেন, আগের দিন, অর্থাৎ ৩ নভেম্বর রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।

এই খবরে বিক্ষোভ ও শোকে ফেটে পড়েন ছাত্ররা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে মধুর ক্যান্টিনে আবারও সমাবেশ করেন তারা। বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে ৫ নভেম্বর ঢাকায় আধাবেলা হরতালের ডাক দেওয়া হয়।

৫ নভেম্বর সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত হরতাল শেষে ছাত্ররা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে গিয়ে গায়েবানা জানাজা পড়েন। পরের দিনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ হয়। কিন্তু ৭ নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান এবং সেনাশাসন চলে আসায় মুজিব হত্যার প্রতিবাদের প্রথম পর্যায়ের সেখানেই সমাপ্তি ঘটে।

প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল কীভাবে তার একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় নূহ-উল-আলম লেনিন ও অজয় দাশগুপ্তের ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড :প্রতিবাদের প্রথম বছর’ গ্রন্থ থেকে। দুজনেই সে সময়ে জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। তারা ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী-সমর্থকদের সংগঠিত করেছেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখেছেন তার দালিলিক প্রমাণ মেলে।

নূহ উল আলম লেনিন বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর আচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসার কথা। তার আগের রাতে আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজগোজের কাজে ব্যস্ত। শেখ কামাল অনেক রাত পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিলেন। পরের দিন আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত তখন ভোরে রেডিওতে মেজর ডালিমের সেই স্পর্ধিত কণ্ঠ শুনি। আমাদের সবার মনে তখন এক প্রশ্ন- কী করা যায়? সেদিন বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি। আমরা ছাত্ররা অপেক্ষা করেছিলাম। অনেকে আমাদের ধৈর্য ধরতে বলেন। পরে প্রায় দুই মাস পরে আমরা সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদে শামিল হই।

৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের বটতলা থেকে শোক মিছিল বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে যায়। তখন খন্দকার মোশতাক আহমদ ও জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, রাজপথে শেখ মুজিবের হত্যার নিন্দা করে মিছিল বের হলে পাখির মতো গুলি চালিয়ে হত্যা করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *