মেয়ের নামটি অর্ণি——– আকিব শিকদার

সাহিত্য ও সাংস্কৃতি


মেয়ের নামটি অর্ণি
আকিব শিকদার

ডাক্তারের চেম্বার। মহিলা ডাক্তার আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখচ্ছেন। মনিটরে একটা মানব শিশুর অস্পষ্ট আকৃতি নড়াচড়া করছে। ডাক্তার জানালেন অনাগত সন্তানটি মেয়ে। স্বামী—স্ত্রী পরস্পরের দিকে মুখ ফেরালো। দুজনের মুখেই তৃপ্তির হাসি।

বাসায় ফেরার বেলায় রিক্সাতে নিঝুমের মুখে রোদ লাগছিলো দেখে অর্ক হাতের ছায়া দিয়ে বউয়ের মুখ ঢাকলো। সাবধানে হাত ধরে রিকশা থেকে নামিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দুতলায় উঠার সময় কোলে তুলে নিতে চাইল। নিঝুম বলল— পাগল।

নিঝুমের শাশুড়ি ডায়াবেটিসের রুগি। বিকালে পার্কে হাটা শেষে ফেরার পথে হকারের কাছ থেকে দুটো শিশুদের ছড়ার বই কিনে নিয়ে আসলো। নিঝুম তো অবাক! শ্বাশুড়ির দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকাতেই শ্বাশুড়ি বললো— ক’দিন পরে তো লাগবেই, তাই আগেভাগেই নিয়ে এলাম।
ঘরের দেয়ালে দুটো বাচ্চার ছবি ঝোলানো। নিঝুম সারাদিন মোবাইলে, ইউটিউবে বেবি কেয়ার লিখে সার্চ দিয়ে শিশু সেবার পদ্ধতি সম্পর্কে জানলো। দিনদিন তার পেট তরমুজের মতো ফুলে উঠছে।

অফিস থেকে ফেরার সময় অর্ক দুই জোড়া জুতা নিয়ে ফিরলো। একই কালার, একই ডিজাইন, শুধু সাইজের পার্থক্য। বড় আর ছোট। বড়গুলো মায়ের জন্য, ছোটগুলো মেয়ের। সাথে একটা রাবারের খেলনা ডলফিন। ডলফিনটা নিয়ে দুজন দুজনকে ভয় দেখানোর ভঙ্গি করলো। অর্ক হঠাৎ নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। কপালে চুমু খেলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল— আমাদের মেয়ের নাম রাখব অর্ণি। অর্কের ‘অর’ নিঝুমের ‘নি’।

এমন সময় নিঝুম কুকড়ে উঠলো। ইশারায় বোঝালো পেটের ভেতর বাচ্চাটা নড়েচড়ে উঠেছে। অর্ক পেটে কান পাতলো, মুচকি হাসি দিলো। তারপর চুমু খেলো, যেন মেয়েকেই চুমু খাচ্ছে।
সময় ঘনিয়ে আসছে। গোসলখানার মেঝেতে পা পিছলে পড়ে গেল নিঝুম। বাইরে থেকে একটা তীব্র চিৎকার শোনা গেল— মাগো… তারপর অ্যাম্বুলেন্সের হর্ন, লালবাত্তিটার ঘোরাঘুরি। স্ট্রেচারে চড়িয়ে সোজা অপারেশন থিয়েটারে। থমথমে পরিবেশে অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাড়িয়ে অর্ক হন্তদন্তের মতো এখানে সেখানে ফোন করছে— রক্ত চাই, রক্ত। ও নেগেটিভ।
ডাক্তার টাওয়েলে মুড়িয়ে নবজাতককে কোলে নিয়ে দরজা খুললো— চাঁদের মত মেয়ে হয়েছে। তবে মা…
কি হয়েছে ডাক্তার? নিঝুম কি মারা গেছে?

ডাক্তারের মাথায় দুষ্ট চক্র ভর করল— না, এখনো মরেনি। তবে জীবন সংকটাপন্ন। আসলে নিঝুম মরে গেছে। ডাক্তার নিজের হাতেই নিঝুমের মুখ চাদর দিয়ে ঢেকে এসেছেন। ডাক্তার চাইছেন কিছু টেস্ট করার ছুতোয় টাকা হাতিয়ে নিতে। প্রাইভেট হাসপাতাল। একটা দিনের সিট ভাড়া মানেও অনেক টাকা। অপারেশন থিয়েটারে থাকা অন্য একজন জুনিয়র ডাক্তার বিষয়টা বলে দিতে চেয়েছিল। তিনি তাকে চোখের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। তারপর আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন— খুব সৎ সাজার ভাব নাও দেখছি! হাসপাতালের লাভ না দেখাতে পারলে চাকরি থাকবে তোমার?
পরদিন সকালে শিশুটি মারা গেল, যার নাম রাখার কথা ছিল অর্ণি। দুপুরে ডাক্তার জানালেন নিঝুমও মারা গেছে। মোটা অংকের বিল চুকিয়ে বউ আর মেয়ের লাশ নিয়ে এম্বুলেন্সে বসল অর্ক। সাদা কাপড়ে মোড়ানো কোলবালিশের মত পাশাপাশি দুটি মরদেহ। একটি ছোট, একটি বড়। একে একে অতীতের স্মৃতি তার মনে পরতে থাকলো। ডাক্তারের কাছে প্রথম দিন আসা, দুই—জোড়া জুতো কিনে বাসায় ফেরা, বউ এর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলা— আমাদের মেয়ের নাম রাখব অর্ণি।

হারুয়া, কিশোরগঞ্জ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *