ঢাকা: বহু কষ্টে পার করেছে করোনাকাল। খেয়ে না খেয়ে দিন গুজরান করেছে তারা। কিন্তু বর্তমান সময়ে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না। আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। ফলে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে তাদের। কঠিন এ পরিস্থিতিতে শহুরে জীবন ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে গ্রামে। কষ্টের জীবন থেকে রেহাই পাওয়ার একটু চেষ্টা। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো হিমশিম খাচ্ছে জীবনযুদ্ধে। এমনই একজন নাজমুল করিম। বেসরকারি চাকরিজীবী।
গ্রামের বাড়ি নওগাঁ সদরের রজাকপুরে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এক কন্যাসহ স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন তিনি। মাসিক বেতন পান ২২ হাজার টাকা। তার পরিবারকে চলতি মাসের ১৫ তারিখে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নাজমুল বলেন, আগে চাল কিনতাম ৫০ টাকা কেজি। এখন সেই চাল ভরা মৌসুমে ৬০ টাকা কেজি হয়েছে। শাক সবজির দাম বাড়ায় অল্প করে খেতাম। বাজারে ৬০ টাকা কেজি’র নিচে কোনো সবজিই নাই। বাজারে তেল ছিল না কিছু দিন। এখন দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। এভাবে আর টিকতে পারলাম না। জীবন বাঁচাতে পরিবারকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করেও শেষ রক্ষা হয়নি নাজমুলের। তিনি বলেন, আমাদের পরিবারের খাদ্য তালিকায় মাছ-মাংস অনেকদিন ধরেই ছিল না। এক বছর তো কেনাই হয়নি। মাছের ধারে কাছেও যেতে পারতাম না। ভরসা ছিল ডিম। ডিমের দামও বাড়তি। ডিম এখন ১৪০ টাকা খাঁচি। তার মানে একটা ডিম এখন প্রায় ১২ টাকার কাছাকাছি।
আমি ৭ থেকে ৮ টাকা পিস ডিম কিনেছি। কোনোভাবে ডিম আর সবজি খেয়ে জীবন কাটিয়েছি। আবার নাকি বিদ্যুতের বিল বাড়বে, গ্যাসের দাম বাড়বে। এতো কিছু বাড়লে কীভাবে চলবো? সামনে আরও কঠিন দিন আসছে। আমি যে চাকরি করি, সেখান থেকে ২২ হাজার টাকা বেতন পাই। এখানে এক ঘর নিয়ে থাকতেই ১০ হাজার ৫শ’ টাকা লাগে। মেয়ের পড়ালেখার খরচ আছে। তাহলে বাকি টাকা দিয়ে এই শহরে কী খাবো তিনজন লোক। তাই জীবন বাঁচাতে আগেভাগেই ওদের পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি একটা মেস ঠিক করেছি। ওইখানেই উঠবো। ওইখানে থাকা-খাওয়াসহ সিটভাড়া বাবদ আমার ৭ হাজার টাকা লাগবে। বাকি টাকা দিয়ে ওরা কোনোভাবে গ্রামে চলতে পারবে। শামীম ইসলামের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানায়। সাভারের আশুলিয়ায় একটি স্যানিটারি দোকানের ম্যানেজার পদে কর্মরত তিনি।
বউ-বাচ্চাসহ পরিবারের মোট সাত সদস্যের পেট চলে তার আয়ে। তিনি বলেন, বেতন যা পাই আর নিত্যপণ্যের যে দাম তাতে চলা খুব কষ্টকর। আগে যখন মাসে চার লিটার তেল লাগতো, এখন তিন লিটার দিয়ে চলার চেষ্টা করছি। খাবারতো খেতেই হবে। আগে সপ্তাহে মাছ-মাংস পাঁচদিন খেলে এখন তিনদিন খাই। এই পরিস্থিতির প্রথম দিকে পরিবার নিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। এখন সাধারণ হোটেলে একবেলা ডাল, সবজি দিয়ে ভাত খেতে ৮০ টাকা লেগে যায়। এখন শাক-সবজিও কিনে খাবার উপায় নেই। নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে তো আমাদের বেতন বাড়েনি। নিত্যপণ্যের দাম পাঁচগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে যদি আমাদের আয়ও পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেতো তাহলে আমার মনে হয় না কারো কোনো সমস্যা থাকতো। এভাবে আর কতদিন সহ্য করা যায়। সইতে না পেরে তাই বউ-বাচ্চাকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলায় বাড়ি সুমির আলীর। পরিবার নিয়ে রাজধানীর মিরপুর-১০ এ থাকেন তিনি। মিরপুরে লোকাল একটি বায়িং হাউজে পোশাক নিরীক্ষার কাজ করেন। তিনি বলেন, গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা এসেছি। গ্রামে থাকতে তামাকের চাষ করতাম। করোনা পরিস্থিতি কোনোভাবে সামাল দিয়ে উঠেছিলাম। এই বছর আসতে না আসতেই নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া।
কোনো কিছুতেই হাত দেয়ার উপায় নেই। আমার দৈনিক হাজিরা ৪০০ টাকা। এক লিটার তেল ২২০ টাকা। চাল ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি। এক বস্তা চাল ২৪শ’ থেকে ২৫শ’ টাকা দিয়ে নেয়া লাগে। ছয় হাজার টাকা ঘর ভাড়া। আমার তো সম্ভব না পাঁচ কেজি তেল একবারে কেনা। আমি হাফ কেজি কিনতে চাই, কেউ এভাবে দিতেও চায় না। তাই বাধ্য হয়ে হাফ কেজি তেল ২২০ টাকা কেজি দরে কেনা লাগে। তাহলে আমি চাল কিনবো কি দিয়ে, আর বাজার করবো কি দিয়ে? আগে ৪০০ টাকা কামাইলে মাছ-মাংসসহ সবজি কেনা হয়ে যেত। এখন যে পরিস্থিতি একটা কিনলে আরেকটা কেনার পয়সা থাকে না। এক আঁটি পুঁই শাকের দাম ৩০ টাকা, শাক খাবো নাকি মাছ খাবো? কোনোটাই হয় না।
আজ দুপুরে কলা-রুটি খেয়ে আছি। হোটেলে খাওয়ারও উপায় নাই। আগে ঢাকায় যখন ব্যাচেলর ছিলাম, খুব শান্তিতে থাকছি। তখন মাসে পাঁচ হাজার টাকা পেলেও চলতে পারছি। এখন মাসে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকাতেও চলতে খুব কষ্ট হয়ে যায়। আমার বাসায় বউসহ এক ছেলে ও মেয়ে আছে। মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। ওর লেখাপড়ার একটা খরচ আছে। ছেলে বেকার, তার কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। এমন পরিস্থিতিতে টিকতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঈদে একবারে গ্রামে চলে যাবো। আর ঢাকায় আসবো না। গ্রামে কি করবেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পরিবার নিয়ে ঢাকা থাকার মতো আর পরিস্থিতি নেই। ওইখানে আগে কৃষি কাজ করতাম। নিজের মাঠের জমি চাষ করতাম। গ্রামে পাঁচ হাজার টাকা কামানো আর ঢাকায় ২০ হাজার টাকা কামানো সমান। মো. সাজু ইসলাম নামের একজন বললেন, ছেলেটার বয়স তিন বছর। স্ত্রী চার মাসের গর্ভবতী। এখন ঢাকায় থাকলে ছেলেটাকে স্কুলে দিতে পারবো না। আবার আরেকটা বাচ্চা। নিরুপায় হয়ে ঢাকা ছাড়লাম। ২০১২ সালে ঢাকায় এসেছিলেন সাজু। ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা কলেজে অনার্সে। এরপর অনার্স শেষ করে মাস্টার্স। ২০১৭ সালে মাস্টার্সে পড়া অবস্থায় বিয়ে করেন। একটি রেস্তোরাঁয় ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতেন। পাশাপাশি নিতে থাকেন সরকারি চাকরির প্রস্তুতি।
কিন্তু সংসারের খরচ মেটাতে না পারায় থাকা হলো না রাজধানীতে। আসার সময় ট্রাক ভাড়া বাঁচানোর জন্য নিয়ে আসেননি কোনো আসবাবপত্র। বিক্রি করেছেন স্বল্প দামে। তিনি বলেন, এমন কোনো মাস নেই যে মাসে টাকা ধার করতে হয় নাই। আমার বেতন ছিল ১৮ হাজার টাকা। অফিসে অনুরোধ করি বেতন বাড়ানোর জন্য। এরপর দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করলো মার্চ মাসে। সাবলেট থাকতাম সব মিলিয়ে ভাড়া দিতে হতো ৭ হাজার ৮০০ টাকা। কিন্তু এই আয়ে যে সংসার চালানো যায় না। আগে রেস্টেুরেন্টে যেতাম রিকশায়, ফিরতাম হেঁটে। ভাড়া লাগতো ৩০ টাকা। এখন ভাড়া চায় ৫০ টাকা। এরপর পায়ে হেঁটে যাওয়া শুরু করলাম। রেস্টুরেন্টে যদি দুপুরের খাবার না দিতো তাহলে না খেয়েই থাকতে হতো।
আমার স্ত্রীর ২০২১ সালের শুরুতে পা ভাঙলো। অপারেশন করাতে হলো। সে সময় খরচ হলো প্রায় ২৫ হাজার টাকা। শুনে অবাক হবেন এক বছর পার হওয়ার পরও সেই টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। এখনো চার হাজার টাকা ধার আছে। সাজুর বাড়ি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার শঠিবাড়ীতে। তিনি বলেন, বাড়ি ভাড়া আর খাওয়া, চালাফেরা সব মিলিয়ে কুলাতে পারছিলাম না। আমি মে মাসের ১৯ তারিখে চাকরি ছেড়ে দেই। ২০ তারিখে ঢাকা ছাড়ি। এই মে মাসে কতদিন যে শুধু ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েছি তার হিসাব নাই। এখন এই ডিমওতো ৪৫ টাকা হালি। এখন গ্রামের বাজারে একটা ছোট দোকান নিয়েছি। মাসে ভাড়া আড়াই হাজার টাকা। জামানত ৫০ হাজার টাকা। এখানে একটা মুদি দোকান দেবো। এই টাকাটা আমার স্ত্রী বাবার বাড়ি থেকে এনেছে। টাকাটা নিতে কষ্ট লাগলেও আমি নিরুপায়। বাড়িতে কিছু জমি আছে বর্গা দেয়া। এগুলো নিজে আবাদ করবো আর দোকানটা চালাবো। ঢাকায় থাকলে বাচ্চা দু’টারে স্কুলে দিতে পারতাম না। এখন দেখি এলাকায় ডাল-ভাত খেয়ে থাকতে পারি কিনা। বাড়ি ভাড়া যেহেতু লাগছে না অল্প আয়েও কোনোরকম খেয়ে বাঁচতে পারবো আশা করি।