বেঁচে থাকার লড়াইকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল উত্তরবঙ্গের “পরিনা”

Slider বাংলার সুখবর

বিশেষ প্রতিনিধি: যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে আছেন ও গণমাধ্যমের সাথে আষ্টেপিষ্টে রয়েছেন, তারা উত্তরবঙ্গের সংগ্রামী মেয়ে পরিনাকে চিনতে পারেন। অবিবাহিত একজন মেয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে কি ভাবে কত কষ্টে জীবন যাপন করছেন তার খবর অনেকের জানা। প্রথম আলো পত্রিকায় এই পরিনাকে নিয়ে একটি খবর বেরিয়েছিল। সেই খবরের পর পরিনা দেশে-বিদেশে নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে আরো বেশী পরিচিত হয়ে উঠেন। প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে তিনি লড়াই করে যাচ্ছেন। বৃদ্ধ মা বাবার বরণপোষণ ও চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন এমনকি নিজে বই পর্যন্ত লিখেন তিনি। মাথাগুজার ঠাঁইও হয়েছে তার। বর্তমানে অনলাইন ব্যবসা করে তিনি জীবন যুদ্ধে অপরাজিতা সৈনিক হিসেবে মাঠে রয়েছেন। বাঁচার লড়াই কাকে বলে পরিনা তা প্রমান করছেন। একটি সাহসী কাজের জন্য মালালারা যেমন নোবেল পেয়ে যান তার চেয়ে অনেক বেশী সাহসী ও সংগ্রামী নারীদের মধ্যে বাংলাদেশের পরিনারা থাকলেও তারা নোবেল চান না। তারা শুধু পথ দেখাতে চান, কি করে একজন নারী নিজের খরচে নিজের লেখাপড়া ও বৃদ্ধ বাবা মায়ের বরণ পোষন করে আবার কবিও হতে পারেন। উত্তরবঙ্গের পরিনা বাংলাদেশের সকল জীবনযোদ্ধার অনুপ্রেরণা, আইকন এমনকি মডেল বলা যায়। জীবন সংগ্রামে পরাজিত সৈনিকদের জন্য পরিনা উঠে দাঁড়ানোর অবলম্বন হয়ে উঠুক। ৮ মে বিশ্ব মা দিবসে পরিনার ফেইসবুক ওয়ালে তার লেখা তার জীবন সংগ্রামের ইতিহাস তার মুখ থেকেই শুনি।

আমার নাম “পরিনা”। আনকমন নাম বলে ছোট বেলা থেকেই নামটা নিয়ে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হই। অনেকেই বলে নামের অর্থ কি! আমি বলতে পারিনা। আসলেও পরিনা নামের অর্থ আমার জানা নেই। বিভিন্ন ডিকশনারিতে খুঁজেও পরিনা নামের অর্থ আমি পাইনি। তাই ধরেই নিয়ে ছিলাম আমি অর্থহীন, আমার নাম অর্থহীন।

কিন্তু ২০২০ সালের ২০ শে অক্টোবর প্রথম আলোতে আমাকে নিয়ে স্টোরি করার সময় প্রিয় বড় ভাই আবুল কালাম মুহাম্মাদ আজাদ ভাই আমার নামের একটি অর্থ করেছেন। সেই স্টোরির প্রথম লাইন হলো, “মেয়েটার নাম পরিনা। অর্থাৎ পরি নয়—মানুষ।” অর্থাৎ আমার নামের অর্থ মানুষ! সত্যি এ বড় পাওয়া। মানুষ যদি হতে পারি আর কিছু চাইনা। আমি মানুষ হতেই চাই। আমার নাম যে শোনে বলে এমন আনকমন নাম কে রেখেছিলো! আসলে আমার একমাত্র ফুফু আমার নামটি রেখেছিলেন। ছোটবেলা একবার ফুফুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ফুফু আমার নাম পরিনা কেন রেখেছিলে!

উত্তরে ফুফু বলেছিলেন, “মা মোর ভাই মানে তোর বাপের কোন ছ্যল (সন্তান) নাই। অনেক চেষ্টা করেও কোন ছ্যল (সন্তান) হয়নি। একদিন কলা বিক্রি করবার যায়ে তোর বাপ তোক প্রায় দশ মাস বয়সে পরে (কুড়িয়ে) পায় সান্তাহার। তবে তোকে পরে (কুড়িয়ে) প্যালেও আমি, তোর বাপ, মা আমরা সবাই খুব খুশি হই একটা ছ্যল (সন্তান) পাওয়ায়। তোকে পরে (কুড়িয়ে) পাইছিলো তাই তোর নাম রাখি “পরিনা।”
নামের মতো আমার জন্ম নিয়েও অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। তাই ফুফুর গল্পটা শুনে আমি অবাক হইনি। কারন আমি বুদ্ধির বয়স থেকেই বিভিন্ন ভাবে শুনেছি আমার ট্রেনে কলা বিক্রেতা বাবা সত্যিই আমাকে প্রায় দশ মাস বয়সে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন সান্তাহার স্টেশনে।
ছোটবেলা থেকেই পাড়া প্রতিবেশী, সহপাঠীদের কাছে থেকে খেলার সময় চুন থেকে পান খসলেই বাস্টার্ড শব্দটা শুনতাম, শুনতাম রেললাইনে কুড়িয়ে পাওয়ার জন্য কুড়ানি উপাধি, শুনতাম ছোটলোক, ফকিরের বাচ্চা শব্দগুলো। আসলে এসব শুনতে শুনতে আমার কান প্রায় ঝালাপালা। খুব খারাপ লাগতো, কাঁদতাম। তবে প্রকাশ্যে কাঁদতে পারতাম না। তাতে পরিহাস আরও বাড়তো, ওরা মজা পেতো। তাই এসব শব্দ শুনতে শুনতে দিনের দিন মুখরা, বদমেজাজি, প্রতিবাদী হয়ে ওঠলাম। প্রকাশ্যে ঝগড়া করলেও, প্রতিবাদ করলেও গোপনে কাঁদতাম।
মেয়েদের এই সমাজে বিশেষ করে গরীব ঘরের মেয়েদের খুব সস্তা ভাবে কিছু কিছু মানুষ রুপি অমানুষ। যুবক থেকে শুরু করে বাবা, দাদা, নানার বয়সী অমানুষগুলোও যখন গোপনে, আকার ইঙ্গিতে এমনকি সরাসরিও খারাপ প্রস্তাব দিতো সত্যি বলছি মাথায় খুন চেপে যেতো। কিন্তু কাউকে বিচার দিতে পারিনি। কে করবে বিচার! গরীবের বিচার হয়না, বরং আমাকেই খারাপ উপাধি দিবে। তাই নিজেই যতটুকু পারতাম প্রতিবাদ করতাম। এমনকি থাপ্পড়ও দিয়েছিলাম একজন সমাজের চোখে গণ্যমান্য, আমার চোখে জঘন্য ব্যক্তিকে। তবে আমি যেমন কাউকে বিচার দিতে পারিনি বিচার হবেনা বলে, তেমনি সেই বুইড়া কুলাঙ্গারও কাউকে বলতে পারেনি চড় খাওয়ার কথা।
যখন স্কুলে পড়ি তখনকার ঘটনা। আমার পড়াশোনা না জানা সরল বাবাকে কোন এক ছেলে হাতে খাম দিয়ে বলেছিলো “চাচা এটাতে ভালো বইয়ের নাম লেখা আছে। আপনার মেয়েকে দিবেন। এই বই পড়লে তার রেজাল্ট ভালো হবে।”
আমি খামটা খুলে দেখলাম তাতে মোবাইল নাম্বার লিখে লেখা আছে, তোমাকে আমার খুব পছন্দ। দেখা করো জয়পুরহাট, তোমার যা যা লাগবে সব আমি দিবো। টাকা পয়সা, কসমেটিকস, দামী পোশাক সব। শুধু বিনিময়ে আমার সঙ্গে সেক্স করবে। আমাকে কল দিও।
কাগজটা হাতে নিয়ে সমস্ত শরীর আমার রাগে কাঁপছিলো। বাবা মাকে কিছু বললাম না। কারন তারা রাগে চিৎকার করবে। আরও দশজন জানবে। লাভের লাভ আমার কিছু হবেনা, বরং ক্ষতি হবে। জীবনেও প্রায়ভেট না পড়া অঙ্কে কাঁচা আমি অনেক ছোটবেলা থেকেই জীবনের লাভ লসের হিসাব ঠিকই শিখেছি, শিখতে হয়েছে, সময় শিখিয়েছে আমাকে।
আব্বাকে বললাম, আব্বা উনার সঙ্গে দেখা হলে বলবে আমার মেয়ের এই বই আছে।
এমন অসংখ্য ঘটনা আছে কয়টার কথা বলবো! তবে হ্যাঁ এটা ঠিক আপনি যদি সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করেন এবং আপনি যদি খারাপ না হতে চান তাহলে কারও ক্ষমতা নেই আপনাকে খারাপ পথে নিয়ে যাওয়ার। বড়জোর তারা আপনাকে না পাওয়ার জ্বালায় আপনাকে নিয়ে মিথ্যা মুখরোচক গল্প বলে আপনার চরিত্র নিয়ে মিথ্যা দুর্নাম রটানোর চেষ্টা করে কৃত্রিম সুখ পাওয়ার চেষ্টা করবে। এতে অবশ্য কিচ্ছু যায় আসেনা আমার। কারন আমি আমাকে নিজের বিবেকের আয়নায় দেখি, অন্য কারও আয়নায় নয়।
জামালগঞ্জ আমাদের যে বাড়ি ছিলো বাবুই পাখির বাসার মতো ঝুপড়ি ঘর। আমি বৃষ্টি উপভোগ করতে পারিনি কোনদিন। বান্ধবীদের বলতে শুনতাম, “আহা বৃষ্টি এলে দারুণ মজা! ঘুম ভালো হয়!”
কিন্তু আকাশে মেঘ জমলে আমার মনে মেঘ জমতো। কারন আমাদের ঘরের চাল খড়ের অভাবে পলিথিনের পাতলা কাগজ দেয়া থাকতো। বৃষ্টি হলে, হালকা বাতাস হলে কাগজ ছিড়ে যেতো। ঘরে পানি পড়তো, বিছানা ভিজে যেতো, সারারাত বিছানাপত্র গুছিয়ে বসে থাকতে হতো। এভাবেই বছরের পর বছর কেটে গেছে। তবুও আমি সুখী। কারন আব্বা আম্মা কখনো আমাকে কটু কথা বলেনি, আজ পর্যন্ত বলেননি একবারও যে আমি তাদের সন্তান নয়। আমি কষ্টে থাকলেও কাউকে বুঝতে দিতাম না।
একবার জামার অভাবে চারদিন গোসল করতে পারিনি। কিন্তু কেউ জানেনা। তখন আমি হাইস্কুলে পড়ি। আম্মা বকে গরমের দিন গোসল করিনা কেন! আম্মাকে বলিনা। কারন নিশ্চয়ই কারও কাছে জামা চাইবে, আর সেই খোঁটা আমাকে শুনতে হবে।
পাঁচ দিনের মাথায় আব্বা রাতে বলে, ” ক্যা মা গরমের দিন গোসল করিস না ক্যান! আব্বা আম্মাকে তখন চুপি চুপি বলি যে আমার গায়ের জামা নেই। যে জামা দুটো ছিলো সেগুলোর একটা জামা এত রিপু হয়েছে যে এবার ছেড়ার পর আর পড়ার মতো নয় এবং এ কথা কাউকে বলতে নিষেধ করি।
পরের দিনই জানিনা আব্বা কিভাবে একটি নতুন জামা এনে দিয়েছিলেন। অল্প ভাত থাকলে আব্বা আম্মা বলে; “ক্ষিধা নাই মা তুই খেয়ে স্কুলে যা।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে কিছু বুঝতে না দিয়েই খুব আনন্দের সাথে কয়েক নোকমা মুখে নিয়েই পানি খেয়ে বলতাম; “ভাতে আকির পড়ছে দাঁতের নিচে আর খাবোনা।” বলেই স্কুলে চলে যেতাম। আব্বা আম্মা তখন ঐ ভাত খেয়ে নিতো। আমরা তিনজনই মিথ্যাবাদী একে অপরকে খাওয়ানোর জন্য।
আমার আব্বা ট্রেনের হকার। কলা বিক্রি করতেন। অনেক সময় সান্তাহার, রাণী নগর স্টেশনে নেমেও কলা বিক্রি করতেন। কোন কোন দিন আমি জেদ ধরতাম সাথে যাওয়ার জন্য। আব্বা নিয়ে যেতেন। তখন দেখতাম ভরা কলার ডালা তুলে মাথায় নিতে কত কষ্ট হতো আব্বার। আব্বা যেখানে কলা বিক্রি করতো পাশে আমি বসে থাকতাম। আমি ছোটবেলায় আব্বাকে তুই ও শালাবেটা বলতাম। আব্বা আম্মা কখনো ভুলটা ধরিয়ে দেয়নি বরং আমার এই সম্বোধনে খুব মজা পেতেন। তাই অনেক বছরই ভুলটা করে গেছি। পরে অবশ্য প্রতিবেশী ফুফুর ধমকে ঠিক হয়ে গিয়েছিলাম।
তো যাইহোক, আব্বার পাশে বসে কলা বিক্রি দেখতাম। ধরুন কেউ তিন হালি কলা নিলো! তিন হালি কলা বিক্রি হলে আব্বাকে বলতাম; আব্বা কয়টা কলায় এক হালি হয়? আব্বা বলতেন, চারটা কলায় এক হালি হয় মা।
তখন বলতাম; তিন হালি কলা ক টেকা দিয়ে কিনিছিলু আব্বা?
আব্বা বলতেন; তিন হালি কলা ৬ টেকা দিয়ে কিনিছিনু মা।
তখন বলতাম; বিক্রি করলু ক টেকা?
আব্বা বলতেন; নয় টেকা।
বলতাম; লাভ হলো ক টেকা?
আব্বা বলতেন; তিন টেকা লাভ হলো।
তখন বলতাম; তাইলে ঐ তিন টেকা দে বরফ খামু।
আব্বা হাসতে হাসতে দিতেন। এভাবে সারাদিনের লাভ খেয়ে নিতাম আর সন্ধ্যার সময় আব্বা আমাকে ফাঁকা কলার ডালার উপর বসিয়ে সেই ডালা মাথায় নিয়ে বাজার থেকে স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে আসতেন।
আমার বাবা মায়ের স্নেহ ছাড়া জামালগঞ্জে আমার ছোটবেলার আর সুখকর স্মৃতি নেই বললেই চলে। তবে আমি যখন ক্লাস এইটে উঠি, তখন ইতিহাসের নতুন শিক্ষক সুমি আপা আসেন। সুমি আপা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এই একটা মানুষ আমার সব কিছু জানা সত্ত্বেও আমাকে অবহেলা নয় বরং স্নেহ করতেন খুব, বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। খুব উৎসাহ দিতেন লেখাপড়ায়, বলতেন আমি ভালো কিছু করবো এক সময়, তখন সবাই দেখবে। আপা আমাকে ইংরেজি পড়ার প্রায়ভেটের বিলও দিয়েছেন। আমার মন ভালো করতে মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতেন ট্রিট দিতেন, বিভিন্ন গিফট করতেন।
শত কষ্টেও আমি খুব হাস্যজ্বল ও চঞ্চল থাকতাম। এটা আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বলা চলে। এজন্যও আমাকে কথা কম শুনতে হয়নি। একজন আমার ঝুপড়ি বাড়িতে গিয়ে বলেছিলো, “ও মাই গড! এই বাড়ির মেয়ে পরিনা! অথচ এমন আচরণ কোথা থেকে শিখলো!
জানিনা উনি আমার কি আচরণে আমাকে কি বাড়ির মনে করেছিলেন।
ঐ ঝুপড়ি বাড়িটা আমার কাছে ছিলো রাজপ্রাসাদ, আমার বাবা মা রাজা রানী আর আমি তাদের রাজকন্যা। সুতরাং চঞ্চলতায় উনি সারপ্রাইজড হলে আমার কি করার!
এমন ভাবেই কৌশলে গাঁ বাচিয়ে চলতাম। কিন্তু কতদিন চলা যায়! অসহ্য ধরে যাচ্ছিলো। দুবার ট্রেনে কেটে আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলাম কিন্তু আব্বা আম্মার কথা মনে করে ফিরে এসেছি আবার।
প্রতিবেশী অনেকেই আব্বা আম্মাকে বলে দেখেশুনে যেনোতেনো হলেও বিয়ে দিয়ে দাও। অযথা পড়াশোনা করিয়ে কি বানাবে! গরীবের আবার লেখাপড়া! আব্বা আম্মাও, বিশেষ করে আম্মা উঠেপড়ে লাগে একটা বিয়ে দেওয়ার জন্য। আমার একই জেদ বিয়ে করবো না।
রাগে একবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই কিন্তু এক ম্যাডাম রাস্তা থেকে ধরে এনে আবার বাসায় দিয়ে যায়। একবার বিয়ে না করার জন্য ভূতে ধরাও সেজেছিলাম। সে এক লম্বা কাহিনী। যাইহোক, অবশেষে আমারই জয় হয়েছে। বিয়ে করিনি। আমার উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং আব্বা আম্মার দেখাশোনা করা।
এভাবেই টেনেটুনে এসএসসি পরীক্ষা দিই ২০০৬ সালে। কিন্তু ফেল করি এক বিষয়ে। পরে ২০০৭ সালে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করি। তারপর জামালগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে এইচএসসি ভর্তি হলেও ফাইনাল পরীক্ষা আর দিতে পারিনি আব্বা আম্মার কষ্ট দেখে।
আব্বার তখন আরও বয়স। কলার ডালি নিয়ে ট্রেনে উঠতে গিয়ে একদিন সামান্যর জন্য ট্রেনের নিচে পড়েনি। এই কথা শোনার পর ঠিক করলাম আমি আর পড়বোনা। পড়াশোনা করে করতে করতে যদি আব্বা আম্মাই মারা যায় তাহলে কাকে খাওয়াবো আমার ইনকাম! কি হবে পড়ালেখা করে! যে করেই হোক আব্বা আম্মার চালের টাকা যোগাড় করবো আমি। এই চিন্তা থেকেই পাশের গ্রামের গার্মেন্টস কর্মী তিনজন মহিলার সাথে ২০০৮ সালে রওনা দিলাম ঢাকা জীবন যুদ্ধে। ওরা তিনজনই বোন। আমিই শুধু বাহিরের।
মহিলা গুলোর সাথে কথা ছিলো তাদের মাসে ১৬০০ টাকা দিতে হবে থাকা ও খাওয়া খরচ বাবদ। বাকি টাকা আমার। ওরা বলল, বেতন ৪০০০ হবে ওভারটাইম তো আছেই। ঐ তিন মহিলার মধ্যে একজনের স্বামী ও এক ছোট মেয়ে ছিলো। বাকি দুজন ডিভোর্সি ব্যাচেলর। কথা ছিলো ব্যাচেলর দুই মহিলার সাথে আমি এক রুমে থাকবো। আর আরেক রুমে স্বামী স্ত্রী ওরা থাকবে।
আমার আম্মা মানুষের বাসায় কাজ করে, চেয়ে চিন্তে যে মণ খানেক ধান জমা করেছিলেন সবটুকু বিক্রি করে আমাকে দিলেন টাকা ঢাকা যাওয়ার জন্য।
কিন্তু একি! ঢাকা গিয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। ওরা বলল আমাকে তাদের মাসে ১৬০০ টাকায় দিতে হবে তবে মহিলাগুলো সবাই দুইটা চকি নিয়ে এক রুমে থাকবে টাকা বাঁচানোর জন্য। ঢাকা শহরে নাকি এমন ভাবে অহরহ থাকে। আমি তো রেগে গেলাম। কেন স্বামী স্ত্রীর সাথে এক রুমে থাকবো!
কিন্তু কিছু করার নেই বিপদে পড়ে কয়েক দিন থাকলাম কিছু না বলে। কারন বাড়িতে অসহায় বৃদ্ধ বাবা মা। তাদের সম্বল বিক্রি করে ঢাকা এলাম। চাল ডালের ব্যবস্থা তাদের করতেই হবে। বেতনও যা বলেছিল তা নয়। মাত্র ২১০০ টাকা বেতন। মনটা খুব খারাপ লাগছে। ১২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে কোয়ালিটির কাজ করে পা ফুলে একদম বেলুন হলো। বেতন সময় মতো হয়না। আর গার্মেন্টস সুপারভাইজার এর ব্যবহার এত খারাপ! এরই মধ্যে ঐ বিবাহিত মহিলার স্বামীর কথাবার্তা, আকার ইঙ্গিত আমার কাছে ভালো লাগলো না। খুব খারাপ লাগলো।
তখন এলাকার পরিচিত আরেক ব্যাচেলর মহিলা থাকে শুনে ওর সাথে সেট হলাম। কিন্তু এই মহিলারও পরে বুঝলাম স্বামী আছে। লোকটার সাথে মাঝখানে সম্পর্ক নাকি ছিলো না। ইদানীং ভালো সম্পর্ক। মহিলাটা বলল তার স্বামী মাঝেমধ্যে আসবে সমস্যা নেই, সে ভালো মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরও আমি যদি না চাই রাতে সে আসবে না।
কিন্তু পরিস্থিতি আমার করে স্বাভাবিক মনে হলো না। এরই মধ্যে আমার জন্ডিস ধরা পড়ে। বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম আবার বাবা মায়ের ঘাড়ে। মাত্র ৮ মাসের মতো ঢাকা ছিলাম। এরই মধ্যে বাকি সবই খোলামেলা, শুধু মনুষ্যত্ব ঢাকা থাকা ঢাকা শহরকে অনেকটাই চিনে ফেললাম। ঢাকাও আমাকে ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো গ্রামে। আব্বা আম্মাকে মাত্র ১০০০ টাকা দিতে পেরেছিলাম।
বাড়ি এসে আবার তীব্র কষ্টের মধ্যে পড়লাম। খুব খুব খুব খুব কষ্ট। আব্বা আম্মার কষ্ট দেখে প্রতি গ্রাস খাবার আমার গলার দিয়ে নামতে চায় না।
খুব ইচ্ছে হতো চিৎকার করে কাঁদার। কিন্তু চিৎকার করে কাঁদার জায়গা নাই। আমার মনে আছে, একবার খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিলো। মাঠের মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়ে পানিতে ভিজতে ভিজতে চিৎকার করে করে কেঁদেছিলাম। বৃষ্টি থামলে যখন বাড়ি আসি প্রতিবেশী এক ভাবি বলেছিলো, “ঢং দেখে আর বাঁচিনা! আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজতে আবার মাঠে যায়!”
একদিন শুনলাম নাটোর প্রাণ কোম্পানি আছে। শুনেই আম্মাকে বললাম আম্মা নাটোর যাওয়ার লোকাল ট্রেনের ভাড়াটা একটু যোগাড় করে দে। আমি নাটোরে যাই। দেখি একটা কাজ হয় কিনা! আম্মা তিন কেজি চাল বিক্রি করে টাকা দিলো। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে গেলাম নাটোর।
কাজ হলো ডেইলি লেবার হিসেবে। কাজটা ভালোই। টাইম কিপারের কাজ। কিন্তু বেতন খুবই কম। কষ্ট অনেক বেশি। তবে মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি পাবো এই আনন্দে শারীরিক কষ্ট আমার কাছে তুচ্ছ মনে হলো।
মাত্র ১২০০ টাকা বেতন। ওভারটাইম হলে ১৭০০/১৮০০ আসে মাসে। তবে ডিউটিকালীন সময়ে এক বেলা ৫ টাকার বিনিময়ে শ্রমিকদের খাবারের ব্যবস্থা ছিলো প্রাণ কোম্পানিতে। বারো ঘন্টা করে ডিউটি
এক সাপ্তাহ নাইট ডিউটি, এক সাপ্তাহ দিন। সন্ধ্যা ৭ টা থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত ১২ ঘন্টা ডিউটি করতে হয়।কোন রকম ঝিমুনির ছবি বস তুলতে পারলে হাজিরা কর্তন, অপমান, সাসপেন্স ইত্যাদি। এত কষ্ট মেনে নিয়েও ভাগ্যিস কাজ শুরু করেছিলাম! কারন এই নাটোর এসে আমি নতুন জীবন পেয়েছি। পেয়েছি মহান এক মানুষ সালেহা আপুর সান্নিধ্য।
প্রথমে শুরু করলাম কাজ প্রাণ লাচ্ছা সেমাই সেকশনে টাইম কিপার হিসেবে। সালেহা আপু সেই সেকশনের ডকুমেন্টস এর ম্যাডাম। মাস্টার্স কমপ্লিট করে শুধু লবিং আর সুযোগের অভাবে সালেহা আপুর মতো মেধাবী মানুষ প্রাণ লাচ্ছা সেমাই সেকশনে আমার জয়েন করার তিনমাস আগে মাত্র ২২৭৫ বেতনে জয়েন করেন। সালেহা আপুর সঙ্গে একই সেকশনে কাজ করার ও রুমমেট হিসেবে থাকার সৌজন্যে পরিচয় শুরু হয়। এখন আত্মার সম্পর্ক আমাদের। বন্ধুত্ব টাকা পয়সা বা বয়স দেখে হয়না। এই জগতে আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড সালেহা আপু। প্রায় ১৪ বছর হতে চলল এক সাথে আছি। কোনদিন আমাদের মনোমালিন্য হয়নি। সালেহা আপুর কথা বলে শেষ করা যাবেনা। আমার দেখা সালেহা আপুর মতো মহান, মহৎ, পরোপকারী, প্রচারবিমুখ, নিভৃতচারী, নির্লোভ, ভদ্র, শান্ত ও কোমল মনের মানুষ এ জগতে বিরল।
আমার জীবনের সকল কথা শুনে সালেহা আপু বললেন, “পরি টাকা আমার ভালো লাগেনা, আমার খাওয়া পড়া হচ্ছে এটাই অনেক, তাছাড়া আমার বাবা মা নেই দুনিয়াতে, আমি আমার বাবা মাকে খাওয়াতে পারিনি আমার ইনকাম। তোমার বাবা মা বেঁচে আছে, অথচ তুমি তাদের দিতে পারছোনা। আমার টাকা দিয়ে তোমার উপকার হবে এটাই আমার বড় পাওয়া।
আর তাছাড়া আমার বলে এই দুনিয়াই কিছু নাই। দেড়শো বছর আগে আমার বলে কিছু এই দুনিয়ায় কিছু ছিলোনা, দেড়শো বছর পরেও থাকবে না।
টাকা সম্পদ সবই দুনিয়াতেই এসে পেয়েছি আবার সবই দুনিয়াতেই থাকবে। তাই এসব আমার দরকার নেই। আজ থেকে আমার সব টাকা তোমার। আর তোমার সব টাকা দিয়ে আব্বা আম্মার বাজার করে দিবে প্রতি মাসে”
তারপর থেকে সালেহা আপু কোনদিন তাঁর বেতনের টাকা হাতে নেয়নি।
শুধু চেকে সই দিয়েছে। আমি তুলেছি বেতন।
আমার মতো করে খরচ করেছি।
আমি যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে আমার বুড়ো বাবা মায়ের খরচ ও ঔষধেই শেষ।
সালেহা আপু এবং আমি সামান্য বেতনে ঘর ভাড়া দিয়ে খুব কষ্টে চলি। অনেক সময় মাসের শেষে আমাদের চাল থাকতো না, চাল কেনার টাকাও থাকতো না। তখন পাশের বাড়িতে মাছকে খাওয়ানোর জন্য ব্রোকেন নুডলস বিক্রি হতো। কম দামী সেই ব্রোকেন নুডলস কিনে এনে সিদ্ধ করে দুজন খেতাম। কিন্তু আমাদের এই অভাবের কথা কাউকে বুঝতে দিতাম না। এমনকি আব্বা আম্মাকে কোন মাসেই বাজার খরচ কম দিতাম না। সামান্য করে বেতন বাড়লে আব্বা আম্মার খরচও বাড়িয়ে দিতাম। এক জুতা বার বার সেলাই করে অফিস করতাম দুজন। কোন ঈদে জামা আমাদের জন্য কিনতাম না। আব্বা আম্মার জন্য সকল কিছু কিনতাম। যখন জামার দরকার হতো, ফুটপাত থেকে ৪৫ টাকা গজের সিট কাপড় কিনে সালেহা আপু এবং আমি জামা বানাইতাম। দশ বছরে একবার গরুর মাংস কিনেছিলাম হাফ কেজি আব্বা আম্মা এসেছিলেন তাই। আড়াইশো টাকা কেজি ছিলো গরুর মাংস।
এত কষ্টের মাঝেও সালেহা আপু সামান্য করে সঞ্চয় করতেন। কারন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কখন চাকরি থাকে বা যায় ঠিক নাই, তাই সঞ্চয়টা করা। যাতে কোন কারনে কর্মহীন হলে আরেকটা চাকরি খোঁজার সময়টুকু যেনো কারও মুখাপেক্ষি হতে না হয়। অন্তত বাবা মায়ের খরচ চালাতে পারি। বহু কষ্টে তিন লক্ষ টাকা সঞ্চয় করে পোস্ট অফিসে পরিবার সঞ্চয়পত্রে রাখি সালেহা আপু ও আমি। এই সঞ্চয় যে আমাদের কত উপকারে এসেছিলো তা বুঝেছিলাম করোনার সময়।
সালেহা আপুও অনেক কষ্টে পড়াশুনা করেছেন।
সালেহা আপু রাজশাহী কলেজ থেকে সমাজ কর্মে মাষ্টার্স কমপ্লিট করেছে। তাঁর জীবনটাও একটা কষ্টের ইতিহাস।
সালেহা আপু আমাকে বলেন পড়াশোনার কোন বয়স নেই। ৭ বছর পড়াশোনা বন্ধ থাকার পরও আবার আমাকে সালেহা আপু নাটোর দ্বীঘাপতিয়া এম কে কলেজে উন্মুক্ততে ভর্তি করে দেন। ২০১৪ সালে আমি HSC পাশ করি। পরে ডিগ্রিতেও ভর্তি করে দেয় রাজশাহী নওহাটা সরকারি ডিগ্রী কলেজে। সেখান থেকে বিএ পাশ করি।
সালেহা আপুর বেতন দিয়ে আমরা দুজন খাই, আমার পড়াশুনা, সালেহা আপুর উৎসাহে কবিতা লেখা ও কবিতার বই প্রকাশ সব হয়। আমার এতো দুর এগিয়ে যাওয়া, সব কিছু সালেহা আপুর কারনেই সম্ভব। তা না হলে কি যে হতো সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
সালেহা আপুর বাসা রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলায়। সালেহা আপুর ভাই বোন এখন আমার ভাই বোন, সালেহা আপুর এলাকা আমার এলাকা। আমি এখন পুঠিয়ার বাসিন্দার মতোই। ১৪ বছর হলো এখানে আছি।
এমনকি আমার আব্বা আম্মাকেও সালেহা আপুর বাসায় এনেছিলাম রাখার জন্য। কারন আমার আব্বা আম্মার যেটুকু বসতভিটা ছিলো তা আব্বার ভাইপোরা পুরাতন দলিল বের করে বলে এই জমি নাকি আব্বা অনেক আগে বিক্রি করেছে আব্বার ভাই এর কাছে। অথচ আব্বা বলে ঐ জমি আব্বা বিক্রি করেনি। আব্বা ঐ জমি আমার নামে লিখে দিয়েছিলেন এবং খারিজও হয় ঐ জমি আমার নামে। অথচ আব্বা আম্মার সাথে আব্বা আম্মার ভাইপোরা বিভিন্ন সময় ক্যাচাল করতো যাতে আমরা বাধ্য হয়ে ওখান থেকে চলে আসি। একটা সময় আব্বা আম্মা যখন ওখানে থাকতে চাইলো না, রাজশাহী চলে আসবে বলল তখন জমি আমি বিক্রি করতে চাইলে ওরা পুরাতন দলিল বের করে বলে জমি ওদের। আমি তো জমির কিছু বুঝিনা। আমার বাবার ভাষ্যমতে আব্বা লেখাপড়া না জানায় একটু জমি বিক্রি করতে গেলে চিটিং করে দলিলে বেশি তুলে নিয়েছে সেই আমলে।
আমি এলাকার চেয়ারম্যানকে বিচার দিলাম। অনেক দিন ডেটের পরে ডেট পড়লো, আব্বার ভাইপোরা চেয়ারম্যানের কাছে থেকে সময় নিতেই থাকলো কাগজ রেডি করতে। আমি রাজশাহী থেকে পাহাড়পুর প্রতি ডেটে যাতায়াত করতাম। অবশেষে তারা কাগজ আনলো, চেয়ারম্যানও তাদের কাগজের কি দেখলেন জানিনা, উনি বিচারে সারে দশ শতক জমির মধ্যে মাত্র দুই শতক আছে বলে আশি হাজার টাকা দিয়ে মিটিয়ে দিলেন। কান্নারত বাবা মাকে নিয়ে জমি ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম সালেহা আপুর বাসায়। সালেহা আপুর ভাইবোন সকলে বাবা মা হিসেবে আনন্দে গ্রহণ করলেন আব্বা আম্মাকে। মেজো বোন একটা ঘর ছেড়ে দিলেন। রান্নাবান্না করে খাওয়ানো, বড় ভাই ঔষধ পত্রের খোঁজ রাখা, কখন কি লাগবে সব কিছু তারা খেয়াল রাখলেন। আমি আর সালেহা আপু চাকরি স্থানে থাকলাম।
এই সুখ বেশিদিন সইলো না। মাত্র তিন মাস থাকার পর আব্বা আম্মা ছোট বাচ্চার মতো জেদ শুরু করলেন।এলাকায় যাওয়ার জন্য। নিজ এলাকার টান তাদের কষ্ট দিচ্ছিলো বুঝলাম। কিন্তু জামালগঞ্জ তো আর যাওয়া সম্ভব না। কারন সেখানে আমাদের কিচ্ছু নেই। বাধ্য হয়ে জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার আওলাই ইউনিয়ন এর শিরট্টি গ্রামে আমার নাম রাখা সেই একমাত্র ফুফুর বাসায় গেলাম। আমার ফুফু ফুফা বেঁচে নেই। তবে পাঁচটা ফুফাতো ভাই আছেন। ভাই ভাবিরা বেশ ভালোই। ছোট ভাইকে অনুরোধ করলাম তার জমিতে বাবা মাকে রাখার জন্য। সে এক কথায় রাজী। আমার ও সালেহা আপুর সাধ্য অনুযায়ী বাবা মাকে ২০ হাজার টাকা খরচ টিনের ঘর বারান্দা করে দিলাম।
প্রতি মাসের এক তারিখে বিকাশে মাসের খরচ পাঠিয়ে দিই। আর সময় সুযোগ মতো গিয়ে দেখে আসি। প্রাণ কোম্পানি সালেহা আপু ও আমাকে সহ লাচছা সেকশন রাজশাহী বিসিকে পাঠায়। আমাদের রাজশাহী পোস্টিং হয়। শহরে বাসা ভাড়া নিই। খরচ বাড়ে। হিসাব করে চলি দুজন।
এরই মধ্যে আমার ৫ টা কাব্যগ্রন্থ, ১ টা ছোট উপন্যাস ও ১ টা গীতিকাব্য প্রকাশ হয়। বেশ ভালো একটু একটু করে সম্মানের সহিত পরিচিতি বাড়তে থাকে।
প্রাণ কোম্পানিতে ৯ বছর চাকরি করার পরও যখন আমার বেতন হয় মাত্র ৯৬০০ টাকা এবং সালেহা আপুর ১২৫০০ টাকা আর অতিরিক্ত পরিশ্রম সেই সাথে কর্মস্থলেও দেখা মেলে মানুষ রুপের অমানুষ কিছু লুচ্চা প্রকৃতির লোকের তখন মনে মনে অন্য জায়গায় চাকরি খুজি।
ঢাকা একটি সরকারি প্রজেক্ট মেট্রোরেলে আমার চাকরি হয়। ২০১৮ সালে প্রাণের চাকরি ছেড়ে যাই, কিন্তু মেট্রোরেলে গিয়ে দেখি পোস্ট যেটা দেওয়ার কথা ছিলো সেটা না দিয়ে নিচের একটি পোস্ট দেয়। আমি মনের বিরুদ্ধে কিছু করিনা। তাই চাকরিটা আমার ভালো না লাগায় করিনা। সালেহা আপু ঢাকা থেকে চলে আসতে বলেন। রাজশাহী এসে প্রাণ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় চাকরিটাতে আর ব্যাক করতে পারিনা। সালেহা আপু বলেন, টেনশন করো না। আমি তো চাকরি করছি। তুমি পড়াশোনা করো। সালেহা আপু তিন মাসের বেতন জমা করে আমাকে একটি কম্পিউটার কিনে দেন। ঘরে বসে অনলাইনে কিছু কাজ করার চেষ্টা করি। মাস ছয়েক হয়। কিন্তু পরে তেমন হয়ে উঠলো না। এরই মধ্যে বিসিকে আরেকটা নতুন জুস কোম্পানিতে অফার পাই। এডমিন এবং এইচ.আর.এম ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করি। বেতন খারাপ নয়। আমাদের মালিক ভালো দক্ষ ডকুমেন্ট চায়। সালেহা আপু এবং আমার এক সাথে থাকা হবে চিন্তা করে প্রাণ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে সালেহা আপুও নতুন এই কোম্পানিতে চলে আসেন। দুজন মিলে খুব ভালোই চাকরিটা করছিলাম। বেতনও ভালো। কিন্তু পাঁচ থেকে ছয় মাস চাকরিটা করার পর মালিকের ব্যক্তিগত কারনে এবং এরই মধ্যে এলো মহামারী করোনা ভাইরাস। কোম্পানিটা বন্ধ হয়ে গেলো।
এমতাবস্থায় সালেহা আপু ও আমি বেকার হয়ে গেলাম। শহরের ভাড়া বাসা ছেড়ে পুঠিয়া সালেহা আপুর গ্রামে এসে মেজো বোনের বাসায় তাদের একটি রুমে ওঠলাম। গ্রামে কম খরচে যেমন তেমন ভাবে আমাদের চলে যায়।
হাতের জমানো টাকা থেকে বাবা মাকে ৮ মাস দিলাম। তারপরও কোন কর্মের ব্যবস্থা করতে পারলাম না। কত জনের কাছে গেলাম! এমনকি এমপি, মেয়রের কাছে পর্যন্ত গিয়েছি। সকলেই দেখছি পর্যন্তই।
এমতাবস্থায় হাতের টাকাও শেষ। তখন ঐ যে পোস্ট অফিসে রাখা তিন লক্ষ টাকার লাভ প্রতিমাসে ২৭০০ করে পাই। ঐখান থেকে বাবা মাকে ১৫০০ করে পাঠাই, আর ১২০০ টাকা দিয়ে আমরা চলি। যে বাবা মাকে প্রতি মাসে ৫০০০ টাকা করে দিতাম, তাঁদের হঠাৎ ১৫০০ টাকা দেওয়ায় বৃদ্ধ বাবা মায়ের কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমরা নিরুপায়! সৎ পথে এর চেয়ে বেশি যে পারিনি।
এমন সময় আমার পাশে দাঁড়ালেন কবি বন্ধু নির্মলেন্দু গুণ দাদু, লেখক মেহতাজ নূর আপু, লেখক ম্যারীনা নাসরীন আপু, গায়িকা এটিএন তারকা ফারহানা আপু, পাঁচবিবির উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুল শহিদ মুন্না ভাই। উনারা আমার বাবা মায়ের জন্য টাকা পাঠিয়েছেন বলেই বাবা মাকে আরেকটু বেশি দিতে পেরেছি।
এরই মধ্যে পরিচয় হলো চমৎকার একজন ভালো মানুষ রাজশাহী ও নওগাঁ জেলার কালচারাল অফিসার শ্রদ্ধেয় আসাদ সরকার স্যারের সাথে। স্যারকে সব বললাম আমার অবস্থা সম্পর্কে। স্যার নিউজ নেটওয়ার্ক এর তিনদিনের ট্রেনিং দিলেন আমাকে। কিছু সম্মানীও থাকে সেই ট্রেনিং এ। যা আমার জন্য ঐ মুহুর্তে অনেক। আর সেই ট্রেনিং এর মাধ্যমেই আসাদ সরকার স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন অসাধারণ একজন ভালো মানুষের সাথে। তিনি রাজশাহী জেলার প্রথম আলোর সাংবাদিক আবুল কালাম মুহাম্মাদ আজাদ ভাই।। ভাই সব কিছু শুনে অনেক চেষ্টা করলেন আমার একটি চাকরির। আসলে দুর্ভাগ্য আমার, চাকরি হলোনা। করোনার দোহায় সবখানে। শেষে ভাই আমাকে নিয়ে স্টোরি করলে প্রথম আলোতে। সেই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর মুহুর্তেই অনেক কয়জন ভালো মানুষ এর দেখা পেলাম।
ঢাকা সাভার উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ শাহাদাৎ হোসেন খাঁন ভাই নিউজ পড়ে আমার বাবা মায়ের জন্য জয়পুরহাট পাঁচ শতক জায়গা কিনে দিলেন। তারপর সেই জায়গার উপর আমাদের পাঁচবিবির উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও মহোদয় স্যার উপজেলার ফান্ড থেকে বাজেট দিয়ে আব্বা আম্মার জন্য দালান বাড়ি ও পানির মটর বসিয়ে দিলেন। নিউজ পড়ে বাবা মায়ের জন্য অনেকেই দোয়া করলেন, বাবা মায়ের জন্য ভালোবাসা স্বরূপ টাকা পাঠালেন। বদলগাছীর ইউএনও স্যার বাবার জন্য বয়স্ক ভাতা করে দিলেন।
অনেক কিছু হলেও চাকরি হলোনা।
অবশেষে নিজেই ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা করলাম। ঠিক করলাম চাকরির পেছনে আর ছুটবো না মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। বরং নিজেই চাকরি এক সময় যেনো মানুষকে দিতে পারি, মানুষের কল্যাণে যেনো লাগতে পারি সেই লক্ষে মনের জোর নিয়ে শূন্য হাতে উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক করলাম অনলাইনে অর্গানিক ফুড সাপ্লাই দিবো। PS Online Market নামে একটি পেজ,
ও PS Online Market নামে একটি গ্রুপ খুললাম এবং আমার দুইটা ফেসবুক আইডি পরিনা পি এস ও Parina Ps থেকে ২০২১ সালে আমের সময় গ্রামের আম বাগানের লাইভ দিলাম। বেশ অর্ডার আসলো। সরাসরি বাগান থেকে ফরমালিন বিহীন আম ভেঙে কুরিয়ার এর মাধ্যমে বাংলাদেশের যে কোন জেলায় সেল করতে লাগলাম। এভাবে আমের মৌসুমে বেশ ভালো আয় করলাম। কৃষকও উপকৃত হলো। কারন আমি সরাসরি আমার ভাড়া দিয়ে বাগান থেকে আম নিলাম। ঢলনও নিলাম না। কৃষককে ৩০ হাজার টাকার মতো সেভ করে দিলাম। এরই ফাঁকে বিভিন্ন গাছের চারাও অনলাইনে দিলাম। আম শেষ হলে শীতের সময় খাঁটি খেজুর গুড় অনলাইনে দিলাম। পাশাপাশি খাঁটি ঘি, ও চাষের খাঁটি মধু দিই। চাকরিতে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যে বেতন পেতাম ব্যবসায় অনেক কম সময়ে তারচেয়ে অনেক বেশি আয় করছি। আমি গ্রামের মাটির রাস্তায় ভ্যান না পেলে পাকা রাস্তা পর্যন্ত নিজে সাইকেল চালিয়ে প্রডাক্ট নিয়ে যাই। বৃষ্টির দিন রেইনকোট পড়ে নিজে ভ্যান ঠেলে আম নিয়ে গেছি কুরিয়ারে। যদিও সবখানে খারাপ মানুষ থাকেই, আমার এমন চলায় রাস্তাপথে বাজে দুই একজন কথা ছোড়ে। সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে কড়া প্রতিবাদ করি। কোন বাঁধায় আমার সামনে আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। আমি আদর্শ হতে চাই থেমে যাওয়া মানুষের নতুন করে চলার পথে।
আমি ব্যবসার পাশাপাশি মাঝে মধ্যে পত্রিকায় কলাম লিখি। নিজের অর্থ দিয়ে সামর্থ্য না থাকলেও sponsor নিয়ে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমও করার চেষ্টা করি।
গত শীতে সাভার উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ শাহাদাৎ হোসেন খাঁন ভাই ও আলোর পথের দিশারি সংগঠন এর খুকু খালামনির থেকে Sponsor নিয়ে জয়পুরহাট ও রাজশাহী জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের শীতার্ত মানুষ, স্টেশনের ভাসামান মানুষের মাঝে ৫০০+ কম্বোল বিতরণ করেছি।
আলোর পথের দিশারি সংগঠন এর Sponsor নিয়ে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কর্মহীন পরিবারে প্রায় ৬০,০০০ (ষাট হাজার) টাকার খাদ্যসামগ্রী দিয়েছি।
ঢাকা কলেজ এর প্রফেসর সাবিনা ম্যাডাম এর Sponsor নিয়ে প্রায় ২১ টা অসহায় পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে ছাগল, সেলাই মেশিন ও নগদ টাকা পূঁজি হিসেবে এককালীন দিয়েছি। আমি অসহায় ছিলাম, তাই আমি জানি এই মানুষগুলোর কষ্ট। যতদিন বাঁচবো জনকল্যাণে কাজ করবো ইনশাআল্লাহ।
একটা সময় আমার জন্ম নিয়ে কষ্ট লাগলেও এখন কোন কষ্ট নেই আমার। আমার গর্ভধারিণী মা যেই হোক আমার সেই মায়ের উপর আগে রাগ থাকলেও এখন আমার কোন রাগ নেই। কারন আমি মেয়ে হয়ে সমাজে চলতে গিয়ে প্রতি ধাপে ধাপে বুঝি কতটা কঠিন মেয়েদের এই সমাজে দাঁড়ানো। নিশ্চয়ই আমাকে গর্ভে ধরা সেই নারীটিও হয়তো কঠিন কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েই বাধ্য হয়ে আমাকে সান্তাহার স্টেশনে রেখে গেছেন। তাই আমার আর আজ তাঁর উপর রাগ নেই। বরং এই সান্তাহার স্টেশনকে আমি “মানবতার দেওয়াল” বলি। কারন এখানেই কেউ একজন তার অপ্রয়োজনীয় জিনিস আমাকে রেখে গিয়েছিলো, যেটাকে আরেকজন প্রয়োজনীয় মনে করে কুড়িয়ে নিয়েছিলো।
কুড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ঐ মানুষটিই আমার বাবা আব্দুল ওহাব, আর আমার মা সাহিদা বেগম। এটাই আমার পরিচয়। আর কোন পরিচয় আমার আর দরকার নেই।
আমার বৃদ্ধ কলা বিক্রেতা বাবা আমাকে যখন কুড়িয়ে নেয় তখনই নাকি বাবার বয়স পঞ্চান্ন ঊর্ধ।
বর্তমানে আমার বাবার বয়স আশি ঊর্ধ। মায়ের বয়সও সত্তর ঊর্ধ। আব্বা আম্মাকে নিয়ে এখন ভালো থাকার সময় আমার। কিন্তু কপালে সুখ সইলো না। হঠাৎ আব্বার ফুসফুস ক্যান্সার ধরা পড়লো। আম্মার কোমড় ও হাঁটুর সমস্যা। কি আর করার! প্রতিকূল অবস্থায় চলার অভ্যাস আমার। সৃষ্টি কর্তার কাছে চাই সহযোগিতা। অসুস্থ দুই বাবা মাকে নিয়ে নতুন করে আরেক যুদ্ধ শুরু। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি তাঁদের ভালো রাখার। কারন জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়ে হলেও সন্তানদের ভালো রাখাই যে মায়ের কাজ!
উনাদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার। আমিই উনাদের বাবা মা। আর উনারা আমার দুই ছেলে মেয়ে। আমার দুই সন্তান। হ্যাঁ আমি সিঙ্গেল মাদার 😇
সকল মাকে শ্রদ্ধা জানাই ❤️❤️

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *