রমজান মাসের শুরুতেই বাজারে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম এক দফা বেড়েছিল। পুরো রমজান মাসেই মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। রমজান শেষে ঈদের দুই দিন পর ৫ মে হঠাৎ সয়াবিন তেলের দাম লিটারে এক লাফে ৩৮-৪৪ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই ধাক্কা সামলানোর আগেই এখন নতুন করে বাজারে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম আরেক দফা বাড়তে শুরু করেছে।
ঈদের পর গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি, আটা, ময়দা, ডিম ও গুঁড়া দুধের দাম নতুন করে বেড়েছে। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় আমদানি করা প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম সামনে আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা।
আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজের পাশাপাশি দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকায়। অথচ সপ্তাহের শুরুতেও পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০-৩৫ টাকা। গত দুই দিনে দাম বেড়েছে ডালেরও। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মোটা দানার মসুর ডালের দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। আর সরু দানা মসুর ডালের কেজি এখন ১৩০ টাকা। ঈদের আগে দাম ছিল ১২০ টাকা।
ঈদের পরও ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া খোলা চিনি গতকাল বৃহস্পতিবার ২ টাকা বেশি দামে ৮২ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। আর কেজিতে ২ টাকা বেড়ে খোলা আটার দাম এখন মানভেদে ৪০-৪২ টাকা। খোলা ময়দায় দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে মোড়কজাত গুঁড়া দুধ। কোম্পানিভেদে কেজিতে ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির গুঁড়া দুধের কেজি এখন ৬৯০ থেকে ৭৫০ টাকা।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর খিলক্ষেত বাজারে কথা হয় গৃহিণী নিলুফা ইয়াসমিনের সঙ্গে। বাজারের মাহিন জেনারেল স্টোর নামের একটি মুদিদোকান থেকে তিনি ৩৯৫ টাকায় তীর কোম্পানির ২ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল, ২২০ টাকায় মোটা দানার ২ কেজি মসুর ডাল, ৮০ টাকায় ২ কেজি আটা, ১২০ টাকায় ৩ কেজি দেশি পেঁয়াজ এবং ১১৫ টাকায় এক ডজন ডিম কেনেন। এতে তাঁর খরচ হয় মোট ৯৩০ টাকা। অথচ এক সপ্তাহ আগের বাজারমূল্য অনুযায়ী, নিলুফার কেনা পণ্যগুলোর দাম প্রায় ১৩৯ টাকা কম ছিল। এমন পরিস্থিতিতে মাসের সংসারের খরচের হিসাব মেলানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।
নিলুফা ইয়াসমি বলেন, ‘দেশি মসুর ডাল (সরু দানা) কেনা অনেক আগেই ছেড়েছি। বাচ্চাদের জন্য দেশি মুরগির ডিম কিনতাম, সেটাও বাদ। মোড়কজাত আটা বাদ দিয়ে নিচ্ছি খোলা আটা। কিন্তু কোনো কিছুতেই স্বস্তি নেই।’
এই গৃহিণীর প্রশ্ন, ‘কিছুদিন পরপরই সব জিনিসের দাম বাড়ে, সরকারের কি কিছু করার নেই?’
যে দোকান থেকে নিলুফা পণ্য কিনেছেন, সেই মাহিন জেনারেল স্টোরের মালিক মঈন উদ্দিন বলেন, প্রতি সপ্তাহে বাজারে কোনো না কোনো জিনিসের দাম বাড়ছে। এ নিয়ে পাইকারদের (পাইকারি ব্যবসায়ীরা) কাছে জিজ্ঞেস করলে বলেন উৎপাদন ও আমদানি খরচ বাড়ছে। তিনি বলেন, কোনো জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার খবর ক্রেতাদের জানালেই তাঁরা মুখ ভারী করেন, শুধু খুচরা বিক্রেতাদের দোষারোপ করেন। ক্রেতাদের সঙ্গে দাম নিয়ে নিয়মিতই তর্ক হয়।
মঈন উদ্দিন তাঁর দোকানের জন্য পাইকারিতে পণ্য কেনেন গাজীপুরের টঙ্গী বাজারের পাইকারি দোকান জাকির ট্রেডার্স থেকে। এর মালিক জাকির হোসেনের যুক্তি, মোটা দানার মসুর ডাল আসে বিদেশ থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন আগের চেয়ে বেশি দামে ডাল কিনতে হচ্ছে। তাহলে দেশি মসুর ডালের (সরু দানা) দাম বাড়ছে কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাজারে দেশি ডালের সরবরাহ কিছুটা কম। তাই দাম বেশি।
তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশি মসুর ডালের সরবরাহে ঘাটতি নেই। যেহেতু বিদেশ থেকে আমদানি করা ডালের দাম বেড়েছে, তাই সুযোগ বুঝে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে করেই দেশি মসুর ডালের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়ছে
গতকাল রাজধানীর উত্তরা ১১ ও ৬ নম্বর সেক্টর কাঁচাবাজার, খিলক্ষেত বাজার, মহাখালী কাঁচাবাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজ একই দামে প্রতি কেজি ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যেসব খুচরা দোকানে এক সপ্তাহ আগের কেনা পেঁয়াজ ছিল, সেসব দোকানে প্রতি কেজি দাম নিচ্ছে ৪০ টাকা। আর যেসব দোকানের পেঁয়াজ গত মঙ্গলবার বা বুধবারের কেনা, সেসব দোকানে নেওয়া হচ্ছে ৪৫ টাকা।
পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধ রয়েছে। এ কারণে দেশের খুচরা ও পাইকারি উভয় বাজারে দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।
কারওয়ান বাজারে গতকাল প্রতি পাল্লা (পাঁচ কেজি) দেশি পেঁয়াজ পাইকারিতে ২১০ টাকা আর ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতি পাল্লা ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর খুচরায় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৪৫ টাকা আর ভারতীয় পেঁয়াজ ৩৮ টাকায় বিক্রি করেছেন দোকানিরা।
দেশের অন্যতম পেঁয়াজ চাষের এলাকা পাবনার বিভিন্ন হাটে ঈদের আগে প্রতি মণ (৪০ কেজি) পেঁয়াজ ৯০০-১০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। গতকাল জেলার সুজানগর ও কাশিনাথপুর পাইকারি হাটে পেঁয়াজ প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। অর্থাৎ স্থানীয় হাট পর্যায়েই পেঁয়াজের কেজি পড়ছে ৩০-৩৫ টাকা।
পেঁয়াজের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-উর-রসিদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য দেওয়া অনুমতির মেয়াদ গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ছিল। পরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তা ৫ মে পর্যন্ত বাড়ায়। এরপর নতুন করে আর পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমদানির অনুমতি দিলে বাজার আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
গুঁড়া দুধের দাম সামনে আরও বাড়বে
উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের বাজারে বিভিন্ন মুদিপণ্যের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, কোম্পানিভেদে মোড়কজাত গুঁড়া দুধ বিক্রি হচ্ছে ৬৯০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি। দোকানিরা বলছেন, যেসব কোম্পানির গুঁড়া দুধের মোড়কের গায়ে এখন ৬৯০ টাকা লেখা আছে, মাসখানেক আগেও এর দাম ৬৫০ টাকা ছিল। আর ৭৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া এক কেজি গুঁড়া দুধের দাম মাসখানেক আগে ছিল ৬৯০-৭০০ টাকা।
একটি গুঁড়া দুধ সরবরাহকারী কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি (এসআর) প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানি থেকে তাঁদের শুধু বলা হয়েছে, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি পর্যায়ে ক্রয়মূল্য বেশি পড়ছে। এ কারণেই দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহ আগে সর্বশেষ তাঁদের কোম্পানির গুঁড়া দুধের দাম খুচরা বিক্রয়মূল্য (এমআরপি) ৭৯০ টাকা নির্ধারণ করেছে। অবশ্য ওই সব প্যাকেট এখনো বাজারে সরবরাহ করা হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে, সামনে গুঁড়া দুধের দাম আরও বাড়বে।
বাজারে ফার্মের মুরগির ডিমের দামও বেড়েছে। প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। আর এক ডজন কিনলে দাম রাখা হচ্ছে ১১৫ টাকা। অথচ গত সপ্তাহেও প্রতি হালি ৩৬ টাকা ও প্রতি ডজন ১০৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
কারওয়ান বাজারের ডিম বিক্রেতা মো. টিপু আলী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি, ডিমের দাম কয় টাকা বাড়লে আর ক্ষতি কী!’
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক মাস আগে গত ১০ এপ্রিল প্রতি হালি ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ছিল ৩২-৩৫ টাকা। আর গত বছরের এপ্রিল মাসে ডিমের দাম ছিল ২৮-৩০ টাকা। এক বছরে ডিমের দাম হালিতে বেড়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ।
টিসিবি বলছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, গরুর মাংস, মুরগি ও ডিম—এই ১৫টি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এসব পণ্যের দাম সর্বনিম্ন দেড় শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে বাজারের ওপর সঠিক নজরদারি দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বাজার নজরদারিতে যে চর্চা আছে তা হলো, কখনো কখনো কোনো ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযান চালাচ্ছেন, জরিমানা করছেন। সেটিও নিয়মিতভাবে করা হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থাতেও ত্রুটি রয়েছে। এই ত্রুটি দূর করতে হবে।
অধ্যাপক রুমানা হক বলেন, কোভিডকালে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে অনেক মানুষ। এর সঙ্গে আগের দরিদ্ররা তো রয়েছেই। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এটি সব সময় সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে।