সিডর, আইলা, আম্পানের ক্ষত এখনো রয়ে গেছে সাতক্ষীরা উপকূলে। এর মধ্যে আবার ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’, যেটি নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন উপকূলবাসী। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি এখন ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। এটি আঘাত হানলে বাঁধ ভেঙে আবারও এলাকা প্লাবিত হবে বলে আশঙ্কা করছেন উপকূলের বাসিন্দারা।
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ বড় ভেটখালী গ্রামের সাইফুল ইসলাম জানান, সিডর, আইলা ও সবশেষ আম্পানের আঘাতে বড় ভেটখালিতে যে বাঁধ ভাঙন হয়েছিল তা এখনও পুরোপুরি ঠিক করা হয়নি। আবার যে ঘূর্ণিঝড় আসছে, তা যদি পুরোমাত্রা আঘাত হানে তাহলে বাঁধ ভেঙে চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হবে তাদের। এলাকার হাজার হাজার বিঘার জমির মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সিংহড়তলী গ্রামের বিশ্বজিত রায় বলেন, ‘২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে সিংহড়তলীতে ভাঙন দেখা দেয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকদের বলার পরও কাজ করেনি। অশনি ঝড় আসছে। যদি বাঁধ ভেঙে যায়, তাহলে আমাদের সব শেষ হয়ে যাবে।’
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসীম মৃধা অভিযোগ করেন, তার এলাকায় তিনটি পয়েন্ট খুব ঝুঁকিপূর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বারবার বলার পরও তারা কাজ করছে না। অশনি আঘাত হানলে অনেক জায়গা ভেঙে প্লাবিত হবে উপকূলের বড় একটি অংশ।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ডালিম কুমার ঘরামি বলেন, আম্পান, ইয়াসের রেশ কাটতে না কাটতে আবার অশনির দ্বারপ্রান্তে আমরা। উপকূলীয় এলাকা নদীবেষ্টিত। এখানে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের কারণে প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়। স্থায়ী বাঁধ না হওয়ায় সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয় এ এলাকার মানুষকে।
বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জ তিনটি, বুড়িগোয়ালীনি পাঁচটি, গাবুরায় সাতটি, পদ্মপুকুর আটটি, কাশিমাড়ী একটি, আটুলিয়ায় একটি পয়েন্ট খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। উপকূলের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমজাদুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইউনিয়নটা দ্বীপ ইউনিয়ন। ২৮ কিলোমিটারের মধ্যে আটটি পয়েন্ট খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তাড়াতাড়ি কাজ না করলে অশনি ঝড়ে আবার ভেঙে প্লাবিত হবে।
স্থানীয় সংবাদকর্মী বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘উপকূলের মানুষের দুর্যোগ থেকে বাঁচতে হলে টেকসই বেড়িবাঁধ নিমাণের কোনো বিকল্প নেই। ষাটের দশকের নাজুক বেঁড়িবাধ আজও জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। অশনি আমাদের উপকূলে আঘাত না হানলেও, নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার ফুট পানি বাড়লেই অনেক এলাকার বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হবে।
তিনি জানান, ইয়াসের পরে উপকূলের ১৪৯ কিলোমিটার এলাকায় বেড়িবাঁধের ২৯টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে। ইয়াসের আগে বুলবুল ঝড়ের পর ৪৩টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ছিল। ইয়াসের পরে ১৪টি পয়েন্টের কাজ হলেও এখনও পুরোপুরিভাবে তা শেষ করেনি ঠিকাদারেরা। দ্রুত যদি ঝুঁকিপূর্ণ এসব বাঁধের কাজ না করা যায়, তাহলে সামনে যেকোনো দুর্যোগে উপকূলের মানুষ তাদের সর্বস্ব হারাবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) শ্যামনগর উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী মাসুদ রানা বলেন, অশনি আঘাত হানলে যাতে ক্ষতি কম হয় সে জন্য আমরা পর্যাপ্ত বালুভর্তি জিআই ব্যাগসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রস্তুত রেখেছি। অনেক ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কাজ চলমান রয়েছে।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, ঘূর্ণিঝড় অশনি বর্তমানে আমাদের উপকূল থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। বর্তমানে ২ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত চলছে। ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর প্রভাবে সকাল ১০টা থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল বাছেদ জানান, সোমবার বেলা ১১টায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাদের কাছে বর্তমানে ৪ লাখ নগদ টাকা ও ১৬০ মেট্রিক চাল রয়েছে। ইতিমধ্যে অগ্রিম প্রস্তুতি হিসেবে শ্যামনগর উপজেলায় ১ লাখ টাকা অগ্রিম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মাশরুবা ফেরদৌস জানান, ইতিমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করা হয়েছে। সভা থেকে সব উপজেলাকে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। সাতক্ষীরায় ৪৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো ব্যবহার উপযোগী করার জন্য স্ব-স্ব চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা আজই এসব কেন্দ্র মানুষ বসবাসের উপযোগী করে তুলবেন। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ২ লাখ ১৬ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হবে। এর মধ্যে কেবল শ্যমনগরে ১৮১টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে ১ লাখ ১০ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেওয়া যাবে।
উপকূলীয় বেড়িবাঁধের মধ্যে শ্যামনগরে ২৭টি, আশাশুনিতে ১৭টি, কালীগঞ্জে ২৭টি পয়েন্টেকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলো মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এসব তদারকি করছেন। এ ছাড়া ৮৬টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শুকনা খাবার প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে যাতে দুর্যোগের সময় তা ব্যবহার করা যায়।