আমাদের দেশে গরমকালে প্রচুর সূর্যের আলো পাওয়া যায়। সূর্যের আলোতে গরম লাগে হয়ত অনেকেই ভাবেন। কিন্তু শীতকালে একটু সূর্যের আলো দেখার অপেক্ষায় থাকেন অনেক মানুষ। মানবদেহে সূর্যের আলোর প্রয়োজনীয়তা অনেক। কিন্তু আমরা অনেকেই এটার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারি না। তবে সূর্যের আলো কখনো কখনো মানুষের শরীরের কিছু ক্ষতিও করে থাকে।
ভিটামিন ডি তৈরিতে সাহায্য করে
সূর্যের আলো নিয়ে কথা বলতে গেলে শুরুতেই চলে আসে ভিটামিন ডি’র কথা। এ প্রসঙ্গে ইউনাইটেড হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিষয়ে সিনিয়র কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা: কানিজ মাওলা বলেন, ভিটামিন ডি হচ্ছে ম্যাজিক মেডিসিন।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ ভিটামিন শরীরে পেতে হলে আপনাকে পয়সা খরচ করতে হবে। অর্থাৎ নানা রকম খাবার খেতে হবে, তারপর শরীরে ভিটামিনের যোগান পাবেন। কিন্তু ভিটামিন ডি পাবেন একদম বিনামূল্যে যদি আপনি নিয়মিত সূর্যের আলোতে যান। খাবার দিয়ে শরীরের ভিটামিন ডি’র চাহিদা পূরণ হয় খুব কমই। এই জাদুর বটিকা মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং সূর্যের আলো ছাড়া মানুষের শরীর ভিটামিন ডি প্রস্তুত করতে পারে না।
তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন– এটি একটি চক্রের মতো। মানুষের ত্বকের নিচে এক ধরনের কোলেস্টেরল থাকে। সূর্যের আলোতে গেলে তা ভিটামিন ডি তৈরি করে। ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম তৈরি করে তা ব্যবহারে শরীরকে সহায়তা করে। হাড়, দাঁত, নখের সুরক্ষায় দরকার ক্যালসিয়াম। এই প্রক্রিয়ার শুরু সূর্যের আলোর সাথে ত্বকের সংস্পর্শের মাধ্যমে।
ভিটামিন ডি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শরীরকে সহায়তা করে। এটি পর্যাপ্ত না পেলে শিশুদের পায়ের হাড় বেঁকে যাওয়া রোগ রিকেট হতে পারে। বয়স্কদের হাড় দুর্বল করে দেয় এমন রোগ অস্টিওম্যালাসিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করে। একই ভিটামিন শরীরের ফসফেট নিয়ন্ত্রণ করে। সুস্থ পেশীর জন্যেও এটি দরকার।
তিনি আরো বলেন, আজকাল শহরের মানুষজন চাকরি করে সারাদিন অফিসে থাকে, ছেলে-মেয়েরা স্কুল কোচিংয়ে থাকে। তাদের মাঠে খেলার সুযোগ আগের মতো নেই। তাই গায়ে সূর্যের আলো কম লাগে। আমি জোর গলায় বলতে পারি মানুষের শরীরে এখন ভিটামিন ডি কম। যে ভিটামিন ডি এত কাজে আসে সেটি পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই নিয়মিত সূর্যের আলোতে যেতেই হবে।
মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকারি
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন, মানুষের মন মেজাজ ভালো থাকার জন্য এবং ভালো ঘুমের জন্য সূর্যের আলো খুব প্রয়োজন। সূর্যের আলোর সাথে হিসেব করে ঘড়ির কাটা চলে। আর আমাদের শরীরের যে ঘড়ি আছে সেটির কাটা নিয়ন্ত্রণ করে সূর্যের আলো। এই আলো আমাদের ঘুম পাড়ায় এবং জাগিয়ে তোলে।
তিনি বলেন, সূর্যের আলো এবং অন্ধকার মানুষের শরীরে কিছু হরমোন তৈরি করতে ও তা নিঃসরণে সহায়তা করে। মানুষের ত্বকে সূর্যের আলো পড়লে মেলানিন নামে একটি রাসায়নিক তৈরি হয়। মানুষের ঘুমের জন্য প্রয়োজন যে হরমোন সেটি হচ্ছে মেলাটোনিন। সেটি তৈরিতে এই মেলানিন প্রয়োজন। অন্যদিকে যখন সূর্যের আলো চলে যায় তখন মানুষের শরীরে মেলাটোনিন হরমোনটি নিঃসৃত হয়। তখন আমাদের ঘুম পায়। এভাবেই মানুষের ঘুমের চক্র সূর্যের আলোর ওপর নির্ভরশীল।
অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আরো বলেন, যারা রাতে জেগে থাকে এবং দিনে ঘুমায় তারা তাদের শরীরের এই ঘড়ির কাটার প্রাকৃতিক নিয়ম ভাঙে। শরীর বলে ঘুমাও, কিন্তু আমি জেগে আছি। এতে তাদের আচরণে পরিবর্তন আসে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, বেশি রাগ করে। এদের অনেকে সহজে মাদক গ্রহণে আসক্ত হয়। নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা থাকে। এটাকে বলে সার্কাডিয়ান রিদম স্লিপ ডিজঅর্ডার। ভালো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সূর্যের আলোর নিয়ম মেনে শরীরের ঘড়িকে চলতে দিতে হবে।
সূর্যের আলো মন-মেজাজ কিভাবে ভালো রাখে সেটি ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, সূর্যের আলোতে গেলে মানুষের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামে একটি হরমোন নিঃসরণ হয়। এটি মানুষের মন, মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। যারা নিয়মিত দিনের আলোতে বের হন না, রাতে কাজ করেন তাদের বিষণ্ণতায় বেশি ভুগতে দেখা যায়। যেসব শীতের দেশে সূর্যের আলো কম সময় ধরে থাকে সেসব দেশে মানুষজন বিষন্নতায় ভোগেন বেশি।
সূর্যের আলোতে কখন এবং কতক্ষণ
অধ্যাপক কানিজ মাওলা বলেন, সূর্যের আলো সবচেয়ে ভালো কাজ করে দিনের শুরুতে। যখন আপনার ছায়া আপনার চেয়ে ছোট। গরমকালে প্রতিদিন দশ থেকে পনের মিনিট যথেষ্ট। তবে কী কাপড় পরে আছেন তার ওপরও নির্ভর করবে কতক্ষণ। বেশি ঢেকে থাকা কাপড় পড়লে বেশিক্ষণ থাকতে হবে। তাই শীতকালে ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত।
কোনো ক্ষতি করে কি
সূর্যের আলোর ক্ষতি খুব বেশি নেই। তবে বেশি সময় ধরে থাকলে ত্বকের রঙ পরিবর্তন হয়, ত্বক পুড়ে যায়। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা এনএইচএস তথ্যমতে, সূর্যের আলোতে থাকে ‘আল্ট্রাভায়োলেট লাইট’ বা অতিবেগুনি রশ্মি। সূর্যের আলোতে হঠাৎ করে খুব বেশিক্ষণ থাকলে এই রশ্মি ত্বকের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।