কামালপুরের ছেলে

Slider বাংলার সুখবর


কিশোরগঞ্জঃ হাওরের কৃষক মরহুম হাজী তায়েব উদ্দিনের ছেলে আবদুল হামিদ। বড় হয়েছেন হাওরেই। পাড়ার ছেলেদের সাথে হাতে স্রোত টেনে পুটি মাছ ধরা,‌ ভরদুপুরে ষাড় বাছুর নিয়ে মাঠে চড়াতে যাওয়া, হাওরের পানিতে সারাদিন দাপাদাপি, সাঁতরে নদী পার হওয়া, এগুলো তার শৈশব।

মা তমিজা খাতুন যত্ন করে পান্তা ভাত মুখে তুলে দিয়ে ছেলেকে স্কুলে পাঠাতেন। দূরের স্কুল। শুকনোয় ক্ষেতের আইল ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে যাওয়া। ফিরতি পথে হিজলের কোলে মাথা রেখে একটু জিরিয়ে নেয়া। বর্ষায় স্কুলে যেতে নৌকার বৈঠা টেনে হাতে ফোসকা পড়ে যেত।

স্কুলে যাওয়া আসার পথে দুই-তিন মাইল পর পর গ্রাম। কোনো গ্রামে টাকার অভাবে গরিব কৃষকের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না। পরদিন মায়ের কাছ থেকে বলে ঘরের ‘জাবার’ থেকে কয়েক ‘উরা’ ধান বিক্রি করে সেই মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা। গ্রামবাসীর পারাপারে সমস্যা, বন্ধুরা মিলে টাকা তুলে নতুন কোষা নৌকার ব্যবস্থা করে দেয়া। লুঙ্গি কাছা দিয়ে খালি পায়ে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলা। এই হলো তার কৈশোর।

কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওর মিঠামইনের কামালপুর গ্রাম। এই গ্রামে শিক্ষিত মানুষ খুব কম। শুধু এই গ্রাম কেন, পুরো হাওরই শিক্ষায় পিছিয়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থা অখ্যাত। হাওরের ওই গ্রামের ছেলে তেল জবজব চুলে সিঁথি কেটে জেলা শহরের কলেজে ভর্তি হলেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হলেন। জড়ালেন রাজনীতিতে।

বাড়ির ধান বিক্রির টাকায় চলল পড়াশোনা, শহরে থাকা-খাওয়া। কি এক জাদু ছেলেটার আচার-আচরণে! হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তার পিছে রাজনীতিতে এসে জড়ো হলো শহরের শত শত ‘স্মার্ট’ ছেলে। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর নজরে পড়লেন। আইন পেশায় যুক্ত হলেন, এমপি হলেন, স্পিকার হলেন, এখন রাষ্ট্রপতি। বাংলাদেশের ইতিহাসে টানা দুই দুইবারের রাষ্ট্রপতি।

রাষ্ট্রপতি মানে বঙ্গভবন, বিশেষ নিরাপত্তা, নানা বিধি-নিষেধ। কামালপুরের ছেলের এসব ধরাবাঁধা নিয়ম ভালো লাগে না। ভালো লাগবে কি করে, ছোট সময় থেকেই যে তার মানুষের সাথে মিশে অভ্যাস!

বঙ্গভবনের দুয়ার খুলে দিলেন। এলাকার শত শত মানুষ আসতে লাগল। তাদের সুখ দুঃখের কথা শুনেন। কোথায় কি সহযোগিতা লাগবে তা লিখে রাখেন।

এসব করেও তার মন ভরে না। মুক্ত পাখির মতো তিনি থাকতে চান। সব মানুষের কাছাকাছি তিনি আসতে চান। হাওরের আকাশ বাতাস তাকে টানে।

অনেকবার তিনি তার বক্তৃতায় বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি হয়ে আমি এখন বন্দী পাখি। আমি বন্দী কারাগারে। মানুষের সাথে না মিশে আমি থাকতে পারি না, সাধারণ মানুষের জন্যই আমার রাজনীতি।’

মানুষের টানে তাই তিনি সুযোগ পেলেই ছুটে আসেন তার জন্মস্থান হাওর এলাকা কিশোরগঞ্জে। খোঁজ খবর নেন সাধারণ মানুষের।

রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এখন পিছিয়ে থাকা সেই হাওরকে উন্নয়নে সমৃদ্ধ করেছেন। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে নির্মাণ হয়েছে দৃষ্টিনন্দন সড়ক, ব্রিজ কালভার্ট। গড়ে উঠেছে উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এবার চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে উড়ালসড়ক। মিঠামইন সদর থেকে শুরু হয়ে নিকলীর ভাটিবরাটিয়ার উপর দিয়ে এসে এটি শেষ হবে করিমগঞ্জের খয়রত গ্রামে।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বড় ছেলে ও কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, ‘আমার বাবার মতো এত উদারমনের রাজনীতিবিদ আর দেখি নাই। সারাক্ষণ তিনি সাধারণ মানুষের সান্নিধ্য পেতে পছন্দ করেন। সারা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেছেন। এখনো তিনি সাধারণ মানুষের দোয়া নিয়েই বাঁচতে চান। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার কোনো আলাদা অহংবোধ নেই।’

গত ২৭ মার্চ থেকে পাঁচ দিনের সফরে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এখন তার জন্মস্থান কিশোরগঞ্জ মিঠামইন আছেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি তার এলাকার লোকজনের সাথে দেখা করছেন। ঘুরে ঘুরে দেখছেন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। বাজার ঘুরে দেখছেন। দুপুরে আশপাশের কার ঘরে কি রান্না হয়েছে, রাতে কি খাবার হবে তারও খোঁজ নিচ্ছেন।

সোমবার বিকেলে মিঠামইনে হাওরের মাঝখানে ধূলিযুক্ত একটি কালভার্টে নিরবে বসে কিছুক্ষণ সময় কাটান তিনি। তার সেই ছবি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সাধারণ পোশাকে স্যান্ডেল পায়ে একাকী তিনি বসে আছেন, হয়তো স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন তার শৈশবের।

মঙ্গলবার মিঠামইন উপজেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের অগ্রগতির খোঁজ-খবর নেন তিনি। বিকেলে তিনি মিঠামইন সেনানিবাস পরিদর্শন করেন। পরে বিকেল ৫টায় অষ্টগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ পরিদর্শন করেন তিনি। সন্ধ্যা ৭টায় ছিল স্থানীয় অডিটরিয়ামে এলাকার লোকজনের সাথে তার মতবিনিময়ের সূচি।

বুধবার (৩০ মার্চ) বিকেল ৩টায় তিনি যাবেন কিশোরগঞ্জ সদরে। সেখানে বিকেল ৫টায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করবেন। এটি নির্মাণ উপলক্ষে সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা সভায় অংশ নেবেন। এসময় তার পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাথেও দেখা হবে।

কিশোরগঞ্জে তথা ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম এলাকার মানুষ তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ডাকেন না। কারো কাছে তিনি ‘হামিদ ভাই’, কারো কাছে ‘হামিদ চাচা’। এলাকায় দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে তিনি অতি প্রিয় মানুষ। গ্রামের নাতি-নাতনিদের কাছে তিনি ‘হামিদ দাদা’। তার সমবয়সীরা তাকে ‘তুই’ বা ‘তুমি’ বলেও ডাকেন। কারণ, রাষ্ট্রপতি হলেও তিনি যে তাদেরই ছেলে, কামালপুরের ছেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *