ঢাকা: ড্যান্স ক্লাবের আড়ালে নারী পাচারের ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতেছে একটি চক্র। তরুণীদের নাচ-গান শেখানোর কথা বলে ব্লাইমেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে বাধ্য করানো হয়। এই ক্লাবের মাধ্যমেই চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে শতাধিক নারীকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব। এরই মধ্যে দু’জন নারী দেশটির কারাগারে রয়েছেন। এ পাচার চক্রের মূল হোতা কামরুল ইসলাম জলিল ওরফে ডিজে কামরুল। ড্যান্স ক্লাবে বা সেলুনে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে এসব নারীকে পাচার করা হতো। গত শুক্রবার রাতভর রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, তেজগাঁও এবং চুয়াডাঙ্গায় অভিযান চালিয়ে বিদেশে পাচার হতে যাওয়া ২৩ জন নারীকে উদ্ধার করে র্যাব। এ সময় নারী পাচারচক্রের প্রধান অভিযুক্তসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- কামরুল ইসলাম জলিল ওরফে ডিজে কামরুল, রিপন মোল্লা, আসাদুজ্জামান সেলিম, নাইমুর রহমান, মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচারচক্রের সদস্য নুর নবী ভুঁইয়া রানা, আবুল বাশার, আল ইমরান, মনিরুজ্জামান, শহিদ শিকদার, প্রমোদ চন্দ্র দাস ও টোকন। অভিযানে ৫৩টি পাসপোর্ট, ২০টি মোবাইল, বিদেশী মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার, দুটি মোটরসাইকেলও উদ্ধার করা হয়। র্যাব জানায়, কামরুল ভারতে নারী পাচারচক্রের মূল হোতা।
রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, পার্শ্ববর্তী দেশে মানবপাচারকারী চক্রের মূল হোতা কামরুল ইসলাম জলিল ওরফে ডিজে কামরুল বা ড্যান্স কামরুল। এই চক্রে ১৫-২০ জন সদস্য রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানবপাচার জড়িত। চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কম বয়সী তরুণীদের প্রতারণামূলক ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। প্রথমে চক্রটি ভিকটিমদের নাচ বা ড্যান্স শেখানোর নামে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সুন্দরী মেয়েদের ঢাকায় নিয়ে আসতো। তাদেরকে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা হতো। পরে তাদের পার্শ্ববর্তী দেশে বিভিন্ন চাকরিতে প্রলুব্ধ করে পাচার করতো চক্রটি। এভাবে চক্রটি তিন বছরে শতাধিক মেয়েকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে।
তিনি বলেন, ভিকটিমদের পার্শ্ববর্তী দেশের মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হতো। মূলত পার্শ্ববর্তী দেশে অমানবিক ও অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে তাদের পাচার করতো। এই চক্রটি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।
তারা ভিকটিমদের সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে জানিয়ে কমান্ডার মঈন জানান, এই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশের চক্রের সদস্যরা ভিকটিমদের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে। এরপর বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শহর বা প্রদেশে অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে বিক্রয় করে দিতো। এর পর থেকে ভিকটিমদের আর কোনো সন্ধান মিলতো না।
জানা গেছে, ২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন কামরুল। এরপর বাড্ডা এলাকায় রিকশাচালক হিসেবে জীবিকা শুরু করেন। কিছুদিন পর একটি কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যানচালক হিসেবে কাজ নেন। এরপর ড্যান্স গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে হাতিরঝিল এলাকায় ‘ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম’ নামে একটি ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এই ড্যান্স ক্লাবের মাধ্যমে উঠতি বয়সী মেয়েদের বিনোদন জগতে প্রবেশের জন্য প্রলুব্ধ করা হতো। একপর্যায়ে তাদের উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করা হতো।
র্যাব জানায়, সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশের তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর পার্শ্ববর্তী দেশে মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা বস রাফিসহ চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। এছাড়া একজন মহীয়সী ‘মা’ জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে নিজে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে মেয়েকে পাচারকারীদের কাছ থেকে উদ্ধারের ঘটনা ভাইরাল হয়।
র্যাব আরো জানায়, কামরুলের মাধ্যমে এক নারীকে ভারতে পাচারের ঘটনায় তার বোন বাড্ডা থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন। সেই মামলায় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি পুলিশ তাকে আটক করে। তিন মাস পর কারাগার থেকে বের হয়ে পুনরায় নারী পাচারে জড়িয়ে পড়ে। এসব নারীকে সীমান্তবর্তী জেলায় অবস্থিত সেফ হাউজে রাখা হতো। পরবর্তীতে সেফ হাউজে থাকা অবস্থায় তাদের মোবাইল নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হতো। এরপর সুবিধাজনক সময়ে চক্রের সদস্যরা নারীদের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করতো। এই চক্রের গ্রেফতার রিপন, সেলিম এবং শামীম নারী পাচারের অবৈধ কাজে মূল হোতাকে সহায়তা করত বলে স্বীকার করেছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে পাচার চক্রের সদস্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এটি মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী একটি চক্র। চক্রের ১০-১২ জন দেশে সক্রিয় রয়েছে। ৫-৭ বছর যাবত এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে নারী ও পুরুষ পাচার করে আসছিল। হাউজকিপিং, নার্স, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি পেশায় নারী কর্মীদের বিনা অর্থে প্রেরণের প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি বয়সী তরুণী ও মধ্যবয়স্ক নারীদের প্রলুব্ধ করত চক্রটি। মূলত বিদেশে পাচারের মাধ্যমে ভিকটিমদের বিক্রি করে দেয়া হতো। চক্রটি ইতোমধ্যে ৩০-৩৫ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। পাচারকারীরা ঢাকায় কয়েকটি সেফ হাউজ পরিচালনা করে। বেশ কয়েক দিন সেফ হাউজে ভিকটিমদের আটকে রেখে পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ভিকটিমদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হতো।
র্যাব জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে পাচারের সঙ্গে জড়িত চক্রটি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। তারা কয়েকটি ধাপে বিভিন্ন দেশে নারী পাচার করে আসছে। প্রথমত তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে উঠতি বয়সী এবং আর্থিকভাবে অসচ্ছল তরুণ-তরুণী ও মধ্যবয়স্ক নারীদের টার্গেট করে তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে। এরপর বিদেশে বিভিন্ন লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখায়। প্রস্তাবে রাজি হলে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে তাদের ঢাকায় অবস্থিত সাজানো অফিসে নেয়া হতো। পরে বিদেশে যাওয়ার জন্য স্বল্পকালীন ভুয়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হতো। কোনো নারী বিদেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে তাদের কাছে দেড় হতে দুই লাখ টাকা দাবি করতো। এই মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারকারী চক্রের মূল হোতা নূর নবী ভুঁইয়া রানা। তিনি লক্ষ্মীপুরের একটি কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৯৬ সালে ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে প্রবাসী হিসেবে কাজ করেন। ওমানে থাকা অবস্থায় মানবপাচারকারী একটি চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তখন থেকেই মানবপাচার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে মানবপাচারে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন।