বরিশালে প্রশাসন ও সিটি মেয়রের বিরোধ অবসান হলেও স্টেশন ছাড়তে হচ্ছে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সদর থানার ওসিকে। ইউএনও মুনিবুর রহমানকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এবং ওসি নুরুল ইসলামকে সিলেট রেঞ্জে বদলি করা হয়েছে। গতকাল সোমবার তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সংঘর্ষের বিষয়টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। গতকাল ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনাসভায় তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন, তাদের সঙ্গে যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, তা হতেই পারে। এটা নতুন কিছু নয়, এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এদিকে, রবিবার রাতে অনুষ্ঠিত সমঝোতা বৈঠকটি ফলপ্রসূ হওয়ার মধ্য দিয়ে বরিশাল সদর উপজেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনে চলমান থমথমে অবস্থার অবসান হয়েছে। ফলে চারদিন শেষে বরিশালে স্বস্তি ফিরেছে। গতকাল সকালেই কাজে যোগ দেন নগর ভবনের সব শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ২৪টি করোনা টিকা কেন্দ্রে উপস্থিত হন করপোরেশনের সব স্বেচ্ছাসেবক এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
ইউএনও মুনিবুর রহমান বলেন, এখনো রিলিজ পাইনি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগ দেব। আর ওসি বলেন, এখনো লিখিত আদেশ পাইনি। তবে চলতি সপ্তাহেই সিলেটে যোগদান করবেন বলে জানান তিনি।
এদিকে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের বাস ভবনে অনুষ্ঠিত সমঝোতা বৈঠকে অংশ নেওয়া দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, ইউএনওর বাসায় হামলার ঘটনায় মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে বরিশাল কোতয়ালী থানায় করা দুটি মামলা এবং ইউএনও ও ওসির বিরুদ্ধে আদালতে দাখিল করা দুটি আবেদনের নিষ্পত্তি তদন্তের মাধ্যমে শেষ করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুলিশের তদন্তকারীরা ওই মামলাগুলো তদন্তের পর ফাইনাল রিপোর্ট দেবেন। এর মাধ্যমে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হবে।
ওই কর্মকর্তা গতকাল সকালে আরও বলেন, বরিশালে প্রশাসন, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের মেয়রের মধ্যকার বৈরিতার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনার একটি সম্মানজনক সমাধান করতে দিকনির্দেশনা দেন প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃস্থানীয়দের। এই সমঝোতায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ। ওই কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রীর চাওয়া ছিল প্রশাসন, পুলিশ ও মেয়রপক্ষের যেন সম্মানহানি না ঘটে। যে যে অবস্থানে আছে সে অবস্থানে থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। যেন একপক্ষ আরেকপক্ষের কাজে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। সে অনুযায়ীই গত রবিবার রাতের বৈঠকে আন্তরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক সমাধান করা হয়েছে।
জানা গেছে, বরিশাল কোতয়ালী থানার ওসি নুরুল ইসলামকে গত ১৮ আগস্ট দুপুরে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে সিলেট রেঞ্জে বদলি করা হয়। তবে বিষয়টি গোপন রাখা হয়। কর্তৃপক্ষ তাকে অবমুক্ত না করায় তিনি এতদিন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। গতকাল তাকে বদলি করা স্থানে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে, ইউএনও মুনিবুর রহমানকে ঘটনার এক সপ্তাহ আগে ১০ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। কিন্তু তাকেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবমুক্ত না করায় দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। গতকাল তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগদানের মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, মুনিবুর রহমান ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। বরিশাল সদরের আগে তিনি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ইউএনও ছিলেন। বিসিএস ৩১ ব্যাচের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সেখানে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে মুনিবুর রহমান বলেন, গত বছরের ৭ এপ্রিল পিআইও তপন কুমার বোস আমার স্বাক্ষর জাল করে এক কোটি ১২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। বিষয়টি ধরা পড়ায় তাকে বরখাস্ত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এদিকে বরিশালের ওই ঘটনায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। জানা গেছে, অ্যাসোসিয়েশনের সব নেতা বিবৃতির বিষয়ে জানতেন না। সংগঠনটির সভাপতি সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার, যিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব) জাহিদ ফারুক শামীম। তিনি বরিশাল সদর আসনের এমপি। গত ১৮ আগস্ট রাতে তার ছবি সম্বলিত ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করেই হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। নিজ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর পক্ষ নিয়ে অতিউৎসাহী হয়ে সচিব এমন বিতর্কিত বিবৃতি দিয়েছেন বলে অনেকের মন্তব্য।
উভয়পক্ষের সমঝোতার বিষয়টি ইতিবাচক আখ্যা দিয়ে আগামীতে এ ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে দেশসেবায় নিয়োজিত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বরিশালের বিশিষ্টজনেরা। আর সাধারণ নগরবাসীর দাবি- জনগণকে হয়রানির মতো কর্মসূচি ত্যাগ করতে হবে।
সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসানের বাসভবনে রাত ৯টায় বৈঠক শুরু হয়। চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। বৈঠকে সংঘটিত ঘটনাটি যাতে আর সামনে না বাড়ে, সে বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হন। বৈঠকে সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর, জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার, পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন, মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান, ডিআইজি এসএম আক্তারুজ্জামান, র্যাব-৮ এর অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) জামিল হাসান উপস্থিত ছিলেন। তবে ইউএনও মুনিবুর রহমান এবং ওসি নুরুল ইসলাম ছিলেন না।
বৈঠক শেষে ওই রাতে সিটি করপোরেশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অতীতের ভুল বোঝাবুঝি ভুলে নান্দনিক বরিশাল গড়ার লক্ষ্যে নগর প্রশাসন ও জেলা প্রশাসন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। গতকাল ইউএনও গণমাধ্যমকে বলেন, আমি বৈঠকে ছিলাম না। বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতি অবসানে সমঝোতা হয়েছে; জানতে পেরেছি। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেন, যাতে সামনের দিনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে পারি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পারি সে রকমই একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন বরিশাল মহানগর কমিটির সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল মোতালেব হাওলাদার বলেন, যে কোনো বিষয়ে রাজপথে কর্মসূচি থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু তা আদায়ে জনগণের ভোগান্তির সৃষ্টি হয়; এমন আন্দোলন করা ঠিক নয়। বরিশাল বিভাগীয় বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মহসিন-উল-ইসলাম হাবুল বলেন, রাজনীতিবিদ, সিটি করপোরেশন ও প্রশাসন একে অপরের পরিপূরক। কাউকে ছাড়া কেউ কাজ বাস্তবায়ন করতে পারে না।