‘এক ফল, এক ডলার।’ একটু অন্যরকম মনে হলেও কথাটি কিন্তু ঠিক। পবিত্র কুরআনের সূরা আত-ত্বীনের নামকরণে মরুভূমির ত্বীন ফলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে রংপুরে, যার বাজারমূল্য এখন একটি ফলই এক ডলার। শুধু স্বাদেই অনন্য নয়, পুষ্টিগুণে ভরা এই ফল নিয়ে আশাবাদী কৃষি বিভাগ। আর ফলটি রফতানির স্বপ্ন উদ্যোক্তাদের, যা বদলে দিতে পারে দেশের প্রান্তিক অর্থনীতির রূপরেখাও। অবশ্য সে জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা তৈরির। কৃষি বিভাগও আশাবাদী ফলটির বাণিজ্যিক চাষ নিয়ে।
সরেজমিন দেখা গেছে, তপ্ত মরুভূমির ‘ত্বীন ফল’ ঘর বেঁধেছে বাংলার নাতিশীতোষ্ণ হাওয়া-জল-মাটিতে।
রংপুরের মিঠাপুকুরের শাল্টিগোপালপুরে শুরু হয়েছে রসে ঠাসা ও মিষ্টি ফলটির বাণিজ্যিক চাষ। স্থানীয় কৃষক মিজানুর রহমান ও তার দুই ছেলে রাহাত ও রাতুল মাস সাতেক আগে শাল্টিগোপালপুর চৌপথি বাজারের ৩০০ গজ পশ্চিমে গড়ে তুলেছেন আত-ত্বীন অ্যাগ্রো ফার্ম। নিজস্ব ৩৩ শতক জমিতে গাছ লাগিয়েছেন ৩১০টি। শুরু হয়েছে ফলন। কম বেশি প্রতিটি ফলের ওজন ১০০ গ্রাম, যা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০০ থেকে হাজার টাকায়। তাই ‘এক ফল, এক ডলার’ হিসাবেই ত্বীন চাষ এগিয়ে নিতে চান এই উদ্যোক্তারা। দাম বেশি হওয়ায় বাজারজাতে সরকারের নজর দাবি তাদের।
আত-ত্বীন অ্যাগ্রো ফার্মের উদ্যোক্তা মিজানুর রহমান নয়া দিগন্তকে জানান, আমার দুই ছেলে রাহাত ও রাতুল যখন ত্বীনগাছের চারা জমিতে লাগায়; একেকটা গাছের চারা কিনে আনে প্রায় ৭০০ টাকা করে। আমি শুরুতে হতাশই ছিলাম; কিন্তু যখন তিন মাসের মধ্যে চারা গাছ হয়ে উঠল। ফলও ধরল তখন আমি অবাক। সত্যিই পবিত্র কুরআনের সূরার নামকরণে যে ত্বীন ফল, আসলে সেটির বরকত-রহমত আছে। আমরা বিক্রিও শুরু করেছি। প্রতি কেজি ৭০০ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি করছি। একেটা ফলের ওজন মোটামুটি ১০০ গ্রাম। সাত থেকে ১০টি ফলেই এক কেজি হয়ে যায়। বাগানের পাশাপাশি আমরা চারাও উৎপাদন শুরু করেছি। প্রতিটি চারা প্রকারভেদে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করছি আমরা।
প্রবীণ এই চাষি বলেন, এই ফল চাষ করে এক ফল দিয়ে এক ডলার আয় করা সম্ভব। সে কারণেই আমাদের স্লোগান ‘এক ফল, এক ডলার’। আমরা এটাকে বাইরের দেশে পাঠাতে চাই। এ জন্য সরকারের কৃষি বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে।
উদ্যোক্তার ছেলে ইনাম হাসান রাহাত জানান, জমি বাদে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তিন মাস পরপর ফল দেয়া শুরু হয়েছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং স্থানীয় লোকজন ফার্মে আসছেন। কেউ কিনছেন ফল, আবার কেউ কিনছেন চারা। কেউ চাষের পদ্ধতি জেনে নিচ্ছেন। অনেকে উৎসাহী হয়ে বাণিজ্যিকভাবে চারা লাগানো শুরু করেছেন।
তরুণ এই উদ্যোক্তা আরো জানান, প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ কেজি ফল তুলতে পারছি বাগান থেকে। এগুলো প্রিমিয়ার ফুড শপ, স্বপ্নসহ বিভিন্ন অনলাইন বিক্রেতারা কিনছেন। স্থানীয়রাও কিনছেন। তবে দাম বেশি হওয়ায় ফলটি রফতানি করার ব্যবস্থা করা দরকার। তাহলে অনেক উদ্যোক্তাই এটা চাষ করতে চাইবে। এ ছাড়াও ঢাকাসহ বিভিন্ন সুপার শপে এটি সরাসরি বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।
আত-ত্বীন অ্যাগ্রো ফার্মে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হয়েছে অনেকের। মাসিক ছয় হাজার টাকা বেতনে এখানে ম্যানেজারির দায়িত্ব পালন করেন কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করা যুবক তৌহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, পড়াশোনা শেষ করার পর বিভিন্ন জায়গায় চাকরির ট্রাই করেছি; কিন্তু হয়নি। পরে ত্বীন ফার্মে কাজ শুরু করেছি। এখন এটা দিয়ে সংসার চালাচ্ছি। এ ছাড়াও এখানে দৈনিক মজুরির হিসাবেও প্রতিদিনই তিন থেকে পাঁচজন শ্রমিক কাজ করছে। তাদেরও সংসার ভালো চলছে। তিনি বলেন, কুরআনের সূরার নামে ফলটি হওয়ায় মনে হয় রহমত বেশি হচ্ছে। প্রতিদিন দর্শনাথীদের সেবা দিচ্ছি এবং বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করছি।
রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল জানান, ত্বীন ফলটা মূলত আমাদের বাংলাদেশের ডুমুর সদৃশ্য একটি ফল। আমাদের দেশের ডুমুর একটা অন্য প্রজাতির হওয়ায় স্বাদ তেমন একটা ভালো নয়। কিন্তু বিদেশ থেকে আনা ত্বীন ফলের স্বাদ অনেক ভালো। বিশেষ করে এখানে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, আয়রন, ক্যালসিয়ামÑ এসব খনিজ ও ভিটামিন উপাদান থাকার কারণে ত্বীন ফল শরীরে অনেক পুষ্টি উপাদান জোগান দিতে পারে। বছরব্যাপী ফলের মাধ্যমে মানুষকে পুষ্টি জোগান দেয়ার যে সরকারি কর্মসূচি অব্যাহত আছে; এই ত্বীন ফল সেখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ছাড়াও উদ্যোক্তারা এই ত্বীন ফল চাষ করে সফলতা পাবে। কৃষি বিভাগ বিদেশে রফতানিসহ ফলটির ব্যাপক বাণিজ্যিক চাষের জন্য চাষিদের পরামর্শসহ নানা ধরনের সাপোর্ট দিচ্ছে।
এই কৃষি কর্মকর্তা মনে করেন এটার ব্যপক বাণিজ্যিক চাষ করা গেলে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে বেকারত্ব দূর হবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান তৈরিসহ প্রান্তিক অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।
রংপুর হর্টিকালচার ফার্ম সূত্র জানাচ্ছে, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ত্বীন ফল চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা মিলেছে। পবিত্র কুরআনের সূরা আত ত্বীন-এর নামকরণে পরিচিতি পাওয়া এই ফলটি ভারত, তুরস্ক, মিসর, জর্দান ও যুক্তরাষ্ট্রে আঞ্জির নামে পরিচিত। ডুমুর জাতীয় ফলটির বৈজ্ঞানিক নাম ঋরপঁং পধৎরপধ।
একবার লাগানোর পর ত্বীনগাছের জীবনকাল ৩০ বছরেরও বেশি। প্রতিটি গাছ থেকে প্রথম বছরে এক কেজি, দ্বিতীয় বছরে সাত থেকে ১১ কেজি, তৃতীয় বছরে ২৫ থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত ফল ধরে। প্রতিটি ত্বীন ফল ৭০ থেকে ১১০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। তিন মাস বয়স থেকে ফল দেয়া শুরু করে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযোগী হয়। প্রতিটি গাছে ৭০ থেকে ৮০টি ফল ধরে। সারা বছরই গাছ থেকে ফল পাওয়া যায়। প্রতিটি গাছ ছয় থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। জমি ছাড়াও ছাদবাগানেও ত্বীন চাষ করা যায়।
পুষ্টি বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, উজ্জ্বল ত্বক, ঝলমলে চুল, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, হার্টের সুরক্ষাসহ নানাবিধ পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এই ত্বীন ফল। ফলটি ব্রেস্ট ক্যান্সার রোধে খুবই উপকারী। এ ছাড়াও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়। কোষ্ঠকাঠিন্য ও হাঁপানি রোগ নিরাময় ও মানসিক ক্লান্তি দূর করে। ত্বীন ফলে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়ামসহ নানা ভেষজ গুণ বিদ্যমান, যা শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কাজ করে থাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রংপুর বিভাগীয় সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, ত্বীন ফল একটি অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মাটি এই ফল চাষের জন্য উপকারী। ইতোমধ্যে এই অঞ্চলের রংপুর ও রাজশাহীতে এই ফলের বাণিজ্যিক চাষ করে এর সফলতা দেখিয়েছেন সাহসী কৃষকরা। এখন এটাকে প্রমোট করার দায়িত্ব কৃষি বিভাগের। তাই একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রথম কয়েক বছরে কৃষি বিভাগকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। ফলটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং বিদেশে রফতানি করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।