বিপন্ন পৌনে চার কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন

Slider শিক্ষা

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের পদভারে মুখরিত হওয়ার কথা ছিল আজ। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছুটি ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বহাল থাকবে। এ নিয়ে গত সাড়ে ১৬ মাসে মোট ২২ দফা বাড়ানো হলো ছুটি। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টানা বন্ধ দাঁড়াচ্ছে ৫৩২ দিন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটা তারিখ শেষ হলে ফের আরেকটা সময়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছুটির কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া অনেকটাই তিরোহিত। যদিও সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, অনলাইনে, শিক্ষকদের বাড়িতে পাঠিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আর অন্তর্বর্তীকালীন পাঠ পরিকল্পনা ও অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখনফল অর্জনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে এটা কতটা কার্যকরী হচ্ছে, সেই প্রশ্ন রয়েই গেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রায় পৌনে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন বিপন্ন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

শিক্ষা বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড মতে, করোনা সংক্রমণের হার সর্বনিু ৫ শতাংশে নেমে এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যায়। বর্তমানে দেশে সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে খুলে দেওয়ার অবস্থা নেই। তাই ছুটি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যথাযথ।

কিন্তু প্রশ্নটা একটানা ছুটির ব্যাপারে। পৃথিবীর সব দেশেই লকডাউন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে। আবার খুলে দিয়ে পরিস্থিতির উদ্ভব হলে ফের বন্ধ করেছে। এক্ষেত্রে বিশ্বের ১৪টি দেশ ব্যতিক্রম, যার একটি বাংলাদেশ। তিনি বলেন, গত বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ মাস আমরা সময় পেয়েছিলাম। সেই সময়টায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেত। কেননা, তখন বাংলাদেশের অবস্থা তত খারাপ ছিল না। ‘সামাজিক সংক্রমণ’ ছিল না, তখন কেবল বড় শহরকেন্দ্রিক এর বড় প্রকোপ ছিল।

গত মার্চে ইউনিসেফ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ১৪৭টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে সংস্থাটি বলেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে বিশ্বের আর ১৩টি দেশ। এই দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ১৬৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বাংলাদেশেরই ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লাখ) শিক্ষার্থী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাগাতার বন্ধে প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে গত বছরের তিনটি পাবলিক ও সব অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। সব শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়েছে অটোপাশ। এখন পর্যন্ত এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। বহু প্রচেষ্টায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাগে আনা ‘সেশনজট’ ফিরে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, নতুন করে প্রায় দুই বছরের বেশি সেশনজট জেঁকে বসেছে। এমনকি স্কুল-কলেজে এই সেশনজটের ঢেউ লাগার উপক্রম হয়েছে। যদি ঘোষণা অনুযায়ী আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে এসএসসি-এইচএসসির বিহিত করা না যায়, তবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-এপ্রিলে নির্ধারিত এই দুটি পরীক্ষা পেছাতে হবে।

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, অনলাইন ও দূরশিক্ষণে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চালিয়ে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। প্রথমত বিভিন্ন গবেষণাই প্রমাণ করছে এটা কতটা কার্যকর হচ্ছে। ২৭ জুলাই ওকলা (সংগঠনের নাম) প্রকাশিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেট পরিস্থিতির প্রতিবেদন মতে, ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৫তম। ইন্টারনেটের এমন পরিস্থিতি থেকেই অনলাইন শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লেখাপড়া হচ্ছে না। এতে বাল্যবিবাহ, ঝরে পড়া, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু, শারীরিক ও মানসিক সংকট বাড়তে পারে। স্কুল-কলেজ খোলার পরে অনেক কিছু দৃশ্যমান হবে বলে মনে করেন তিনি।

জানা যায়, অনলাইনে ও দূরশিক্ষণে পাঠদান পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে বিশাল ফারাক আছে। শিক্ষা কার্যক্রমের নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও সর্বশেষ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী, করোনাকালে প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখতে না পারা বা শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান বলেন, করোনা বলেকয়ে আসেনি। এই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সব দেশই মোকাবিলা করছে। কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে, পদক্ষেপটা বাস্তবভিত্তিক হয়নি। অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি নিঃসন্দেহে সৃজনশীল পদক্ষেপ। তবে আমাদের অবকাঠামোগত দিক বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষণ-শিখন কৌশল নির্ধারণ করা যেত। অফলাইন আর অনলাইন এবং দূরশিক্ষণ পদ্ধতির সমন্বয়ে ব্লেন্ডেড পদ্ধতি অল্প সময়েই প্রবর্তন করা যেত। এতে শিখনফল অর্জন আরও কার্যকর হতো।

ডব্লিউএইচও এবং করোনা সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির মতে, সংক্রমণ ৫ শতাংশে নেমে এলে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও সর্বশেষ শনিবারের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সংক্রমণের হার প্রায় ৩১ শতাংশ। এদিন ২১৮ জন করোনায় মারা গেছেন। রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ঘনবসতির এই দেশে এই সামাজিক সংক্রমণ কবে শেষ হবে আর কবে স্কুল খোলা যাবে, সেটা অনিশ্চিত। তাই অতিদ্রুতই অবকাঠামো ও বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী অন্য দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম আরও কার্যকরভাবে অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।

২২ দফা ছুটি বৃদ্ধি : যুগান্তরের আর্কাইভ ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ২২ দফা ছুটি বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে গত ১৬ মার্চ সংবাদ সম্মেলন ডেকে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। প্রথমে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরে প্রথমে ৪ এপ্রিল এবং পরে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এই ছুটি চতুর্থ দফায় বাড়ানো হয় ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোজার ছুটি শুরু হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তা ছিল ১৫ জুন পর্যন্ত।

এরপর একসঙ্গে পৌনে ২ মাস বাড়িয়ে ৬ আগস্ট পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরের দফায় ওই ছুটি ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ে। এরপর এক মাস বাড়িয়ে ছুটি করা হয় ৩ অক্টোবর পর্যন্ত। সেই ছুটি শেষ হওয়ার আগেই ১ অক্টোবর বলা হয়, করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হলো।

২৯ অক্টোবর পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাধারণ ছুটি ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সেই ছুটি শেষ না হতেই ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়। এরপর ঘোষণা দিয়ে প্রথমে ১৬ জানুয়ারি ও পরে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ে ছুটি। পরে ১৪ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় ছুটি বাড়ে।

এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে বৈঠক করে শিক্ষাসহ সরকারের ৬টি মন্ত্রণালয়। পরিস্থিতি পর্যালোচনা শেষে সেদিন ঘোষণা করা হয়, ৩০ মার্চ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা খুলে দেওয়া হবে। আর এর আগের ঘোষণা অনুযায়ী ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হবে। আর শিক্ষার্থীদের ১৭ মে হলে তোলা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পরে খোলার কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, আবাসিক হলে অবস্থান নির্বিঘ্ন করতে ওই সময়ের মধ্যে ১ লাখ ৩১ হাজার ছাত্রছাত্রীকে টিকা দেওয়ার কাজ শেষ করা হবে।

কিন্তু শহরের পাশাপাশি মফস্বল অঞ্চলেও ‘ডেল্টা’ ধরনের করোনাভাইরাসের সংক্রমণে তা আর হয়ে উঠেনি। এ অবস্থায় ২৯ মে বন্ধ রাখার কথা বলা হয়। সেই ছুটি শেষ না হতেই গত ২৬ মে সংবাদ সম্মেলনে ১৩ জুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেন শিক্ষামন্ত্রী।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাও প্রথমে ৩০ জুন ও পরে ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়। আর সর্বশেষ ২৯ জুলাই রাত ১১টায় পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *