নারী চিকিৎসক ঈশিতার এত জালিয়াতি!

Slider নারী ও শিশু


রাজধানীর মিরপুর থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশি ও বিদেশি সংস্থার ভুয়া প্রতিনিধি পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে নারী চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতাকে (আইপিসি) এক সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৪ এর অভিযানে আজ রোববার সকালে রাজধানীর শাহ আলী থানার মিরপুর-১ এলাকা থেকে কথিত তরুণ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতা এবং তার সহযোগী মো. শহিদুল ইসলাম ওরফে দিদারকে গ্রেপ্তার করেছে।

অভিযানের উদ্ধার করা হয়-ভুয়া আইডি কার্ড, ভুয়া ভিজিটিং কার্ড, ভুয়া সিল, ভুয়া সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ৩০০ পিছ ইয়াবা, ৫ বোতল বিদেশি মদ এবং মোবাইল।

রোববার বিকেলে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানিয়েছেন র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উয়িং পরিচাক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা পেশায় একজন চিকিৎসক। যিনি বিভিন্ন মাধ্যমে একজন আলোচক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক, পিএইচডি সম্পন্ন, মানবাধিকার কর্মী, সংগঠক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদ মর্যাদার এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন বলে ভুয়া পরিচয় প্রদান করে থাকেন। ’

ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্ণিত ভুয়া পরিচয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে তিনি ভুয়া নথিপত্র তৈরি ও প্রচার-প্রচারণা করে থাকেন। তিনি ময়মনসিংহে অবস্থিত একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৩ সালে (সেশন ২০০৫-২০০৬) এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। অতঃপর জুন ২০১৪ সালের প্রথম দিকে মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। অতঃপর ২০১৪ সালে তিনি একটি সরকারি সংস্থায় চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে চার মাস চাকরি করার পর শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকরিচ্যুত হন।’

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ; চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তার ভুয়া বিশেষজ্ঞ ডিগ্রিগুলো যথাক্রমে-এমপিএইচ, এমডি, ডিও ইত্যাদি। এছাড়া ভুয়া ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবেও বিভিন্ন মতবাদ প্রচার করে থাকেন। গ্রেপ্তারকৃত বিভিন্ন সাইটে চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, আর্টিকেল বা থিসিস পেপার প্রকাশনা করেছেন তন্মধ্যে; Health problems and health care seeking behavior of street children in Dhaka City, Perception regarding acute respiratory tract infection among mothers of under five children ইত্যাদি। তিনি মূলত অনলাইনে প্রাপ্ত বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রকাশনা এডিট করে বর্ণিত গবেষণাধর্মী প্রকাশনা প্রস্তুত করেছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। ’

র‍্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা জানান তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিদেশে প্রাপ্ত ভুয়া সাফল্য স্বীকৃতের প্রচারণা করতেন। ২০২০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড (আইআইডবিউ ২০২০) পেয়েছেন। যা ৩৫ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে ‘বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী’ হিসেবে পুরস্কার। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ভারতের ‘টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড ২০২০’; থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ‘আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’ ইত্যাদি। তিনি জানান, প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানীতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রচারণা করেন যে, তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বর্ণিত অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।

এছাড়া তিনি অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বিভিন্ন সংগঠন যথাক্রমে আমেরিকান সেক্সুয়াল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল সার্ভিকাল ক্যান্সার কোয়ালিশন এবং গ্লোবাল গুডউইল ইত্যাদি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছেন। তিনি অ্যাওয়ার্ড বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিতির এডিটিং করা ভুয়া ছবি ও সনদ তৈরি করে গণমাধ্যমে পাঠানো ও ভার্চুয়াল জগতে প্রচারণা করতেন।

র‍্যাব আরও জানায়, গ্রেপ্তারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা করোনা মহামারিকে পুঁজি করে ভার্চুয়াল জগতে প্রতারণায় সক্রিয় ছিলেন। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচক ও প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও সার্টিফিকেট প্রদান করে প্রচার-প্রচারণা করেছেন। তিনি বিভিন্ন বিদেশিদের ভুয়া সার্টিফিকেট প্রচারণা করে অন্যান্যদের অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট গ্রহণে আকৃষ্ট করতেন।

এ ছাড়া ইশরাত রফিক ঈশিতা ‘Young World Leaders for Humanity’ নামের একটি অনিবন্ধনকৃত ও অননুমোদিত সংগঠন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। অনলাইন প্লার্টফর্মে যার Facebook page ও Linkedin ID রয়েছে। সংস্থাটির সদর দপ্তর নিউইয়র্কে অবস্থিত বলে প্রচারণা করা হয়েছে। বর্ণিত ফেসবুক পেজের কো-অ্যাডমিন গ্রেপ্তারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা। এই ফেসবুক পেজের মাধ্যমে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতারণা নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বুরুন্ডি, আমেরিকা, নাইজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ হয়েছে। এছাড়াও উক্ত দেশগুলোকে এই সংগঠনের ব্যানারে সেমিনার, অ্যাওয়ার্ড প্রদান ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আয়োজন করা হয়ে থাকে বলে গ্রেপ্তার হওয়া নারী জানান। যেখানে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ভুয়া অ্যাওয়ার্ড বিতরণের বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত অর্থের বেশিরভাগ গ্রেপ্তারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার প্রধান সহযোগী গ্রহণ করে থাকেন বলে জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে বুরুন্ডি ও আফগানিস্তানে এ ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া সংগঠনের ব্যানারে গত ২০১৯ সালে রাজধানীর একটি অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ৩০ জন বাংলাদেশিকেও ‘Young World Leaders for Humanity’ এর সম্মাননা জানানো হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে ইশরাত রফিক ঈশিতা সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন।

এই সংগঠনে বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের বা জনমনে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে এমন ব্যক্তিদের ছবি যুক্ত করে অ্যাডভাইজর, ভাইস চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল ভাইস চেয়ারম্যানসহ নানা পদে যোগদান করেছেন বলে ভুয়া প্রচারণা চালানো হয়।

র‍্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর র‌্যাংক ব্যাচ ও পদ অর্জনের চেষ্টা চালান। তিনি ফিলিপাইনে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট (IPC.Phil.com) থেকে ৪০০ ডলারের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর ন্যায় “বিগ্রেডিয়ার জেনারেল” পদটি পান বলে জানান। এছাড়াও তিনি ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশন ইত্যাদি সদস্য পদের ভুয়া সনদ তৈরি করে প্রচারণা চালিয়ে থাকেন।

ইশরাত রফিক ঈশিতা নিজের ভুয়া ডিগ্রি, পদ ও পদবি প্রচারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আইপি চ্যানেল ব্যবহার করতেন। উক্ত প্রচারণার মাধ্যমে সে বিশিষ্ট আলোচক সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে টকশোতে অংশগ্রহণ করতেন। ক্ষেত্র বিশেষে গণমাধ্যমে তার টকশো, আলোচনা, সাক্ষাতকার ও সাফল্য সমূহ প্রচারিত হয়েছে। মূলত তার ভুয়া সার্টিফিকেট, এডিটিং ছবি, মিথ্যা বিবৃতি ও তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সবাইকে বিভ্রান্ত করতেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী শিশু অধিকার, চিকিৎসা বিজ্ঞান, করোনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে অপচেষ্টা চালাতেন।

বাধা এড়াতে ‘বস’ কৌশল

র‍্যাব সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে পরিচয় প্রদানের ক্ষেত্রে বাধা এড়াতে তার ‘বস’ হিসেবে সহযোগী গ্রেপ্তার হওয়া মো. শহিদুল ইসলাম দিদার ভূমিকা রাখতেন। যিনি টেলিফোন/অনলাইনে এবং ক্ষেত্র বিশেষে স্ব-শরীরে উপস্থিত হয়ে ইশরাত রফিখ ইশিতার পরিচয় বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করতেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনলাইনে বিভিন্ন মিটিংয়ে এই বস উপরোস্থ কর্মকর্তার বর্ণিত ভূমিকা পালন করতেন। কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ‘Young World Leaders for Humanity’ অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেন নাই।

গ্রেপ্তারকৃত মো. শহীদুল ইসলাম দিদার ২০১২ সালে একটি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা (ইঞ্জিনিয়ার) সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমাও সম্পন্ন করেন। বর্তমানে একটি গার্মেন্টেসে কমার্শিয়াল ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। তিনিও ফিলিপাইনে একই সাইট থেকে অর্থের বিনিময়ে মেজর জেনারেল পদ ধারণ করেন বলে জানান।

এছাড়া নিজেকে আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক); ইয়াং ওয়াল্ড লিডার ফর হিউমিনিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের ফাউন্ডার (প্রতিষ্ঠাতা) বা কর্ণধার হিসেবে উপস্থাপন করেন। একইভাবে তিনি দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার দূত বা অ্যাম্বাসেডর হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।

গ্রেপ্তারকৃতরা যোগসাজশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ভুয়া সদস্য, কর্ণধার বা দূত হিসেবে দেশে/বিদেশে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তাদের আরও বেশ কয়েকজন সহযোগী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এসব বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানিয়েছে র‍্যাব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *