করোনাকালে মাসে গড়ে ৫৮টি বাল্যবিয়ে

Slider নারী ও শিশু


সম্প্রতি ঢাকা বিভাগের গাজীপুরের একটি নামকরা স্কুলের শিক্ষার্থীকে তার অমতে পরিবারের সদস্যরা জোরপূর্বক বিয়ে দিতে চাইলে পুলিশের সহায়তায় ওই শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পায়। ওই শিক্ষার্থীকে স্থানীয় কিছু যুবক প্রতিনিয়ত বিরক্ত করতো। যেটা নিয়ে ওই শিক্ষার্থীর পরিবার দুশ্চিন্তায় ছিলেন। পরবর্তীতে পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনদের যৌথ সিদ্ধান্তে পুলিশের এক উচ্চপদে দায়িত্বরত কর্মকর্তার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়। এদিকে করোনা শুরু হওয়ার আগে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ধানুড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীসংখ্যা ছিল ৭১ জন। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয় ৬৩ জন। তবে শেষ পর্যন্ত সেখানে টিকে থাকে ৪৯ ছাত্রী। ঝরে পড়াদের বেশির ভাগ বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছেন, স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর।

তিনি জানান, অভিভাবকদের অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে মেয়েদের বিয়ে ঠেকিয়ে পড়ালেখায় যুক্ত রাখার চেষ্টা করলেও করোনাকালে সেটা সম্ভব হয়নি। এ সময় কমপক্ষে ২০ জন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেশির ভাগই নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বয়স কম থাকায় অনেক মেয়ের বিয়ের নিবন্ধন হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ের দুই-তিন মাস পর মেয়েকে বাবার বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়।

সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির বৈঠকে করোনাকালে বাল্যবিয়ের তথ্য তুলে ধরে এতে বলা হয়, নরসিংদী, নাটোর, কুড়িগ্রাম, যশোর, কুষ্টিয়া ও ঝালকাঠি জেলায় বাল্যবিয়ের হার কিছুটা বেড়েছে। মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের ৬৪ জেলায় মার্চ থেকে জুন চার মাসে ২৩১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। অর্থাৎ মাসে গড়ে ৫৮টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। মন্ত্রণালয় করোনার আগের মাস হিসাবে গত বছরের ফেব্রুয়ারির তথ্য তুলে ধরেছে। তখন বাল্যবিয়ে হয়েছিল ৬টি। বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন করোনাকালে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সহিংসতার তথ্য জানতে একটি জরিপ চালায়। এই সংগঠনের তথ্য অনুসারে গত বছরের মে মাসে ২৭টি জেলায় ১৭০টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। আর ২৩৩টি বাল্যবিয়ে থামিয়েছে তাদের ২৪টি সহযোগী সংগঠন।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলছে করোনাকালে সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে খুব কমসংখ্যক বিয়ে নিবন্ধন হয়েছে। করোনায় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকা এবং সামাজিক নিরাপত্তার অভাবসহ নানা কারণে এই বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। সংস্থাটি বলছে গত বছর করোনার সাত মাসে দেশের ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮শ’ ৮৬টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। যাদের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভধারণ করেন ৫ হাজারেরও বেশি। বাল্যবিয়ের হার বেশি এমন দশটি দেশের মধ্যে ৮ম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ, এমনটিই বলছে ইউনিসেফ। যেটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ঢাকা বিভাগ এবং জেলাগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে চাঁপাই নবাবগঞ্জ।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের বিস্তারের এ সময় বাল্যবিয়ের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামীণ পরিবারগুলোতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা এ সময়টায় দেশে ফিরেছেন। সমাজ বাস্তবতায় প্রবাসে কাজ করা ছেলে ‘পাত্র’ হিসেবে চাহিদা বেশি। আর এই অবরুদ্ধ অবস্থায় বিয়ে দিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন অভিভাবকরা। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এখন কম হচ্ছে। সেই সুযোগও কাজে লাগাচ্ছে কেউ কেউ।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক’র গবেষণা অনুযায়ী, ৮৫ শতাংশ বাল্যবিয়ে হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে। ৭১ শতাংশ হয়েছে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়া ৬২ শতাংশ বিয়ের কারণ ছিল। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টোরাল প্রকল্প বাল্যবিয়ে সব ধরনের নারী নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়টি তদারক করছে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ-এর তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ থেকে ২৮শে এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২১টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব বিস্তারের ভিত্তিতে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে দেখা গেছে, মহামারির কারণে দেশে বাল্যবিয়ে আগের চেয়ে ১৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ হার। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মতে, গত বছর মে, জুন, জুলাই, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে বাল্যবিয়ে উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ-এর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ইকুয়িটি ম্যানজোর কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, করোনার কারণে পরিবারের আয় কমে যাওয়া, দারিদ্র্যতা এসব বিষয় বাল্যবিয়ের মূল কারণ। এছাড়া কিশোরীদের অনেকেই করোনার কারণে বাসায় বদ্ধ পরিবেশে থেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এবং এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেরাই বাল্যবিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন এবং স্কুলের শিক্ষকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধিরা তাদের নিয়মিত খোঁজ-খবর নিতে পারেন। এতে করে শিক্ষার্থীদের বর্তমান অবস্থা সম্পকে তাদের ধারণা থাকবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, করোনার কারণে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। কবে স্কুল খুলবে, কবে তারা পাস করে বের হবে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে, পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তির চাকরি চলে গেছে, দারিদ্র্যতাসহ নানা কারণে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটে থাকে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বাবা-মায়ের যেমন ভূমিকা রয়েছে। একইভাবে স্থানীয় প্রশাসন, স্কুলের শিক্ষক প্রত্যেককেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *