করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সারা দেশে ১৪ দিনের পূর্ণ শাটডাউনের যে সুপারিশ করেছে, তা সক্রিয় বিবেচনায় নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, সরকার করোনা পরিস্থিতি খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় যেকোনো সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি এ কথা বলেন।
ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা তাদের সুপারিশ অ্যাকটিভ কনসিডারেশনে (সক্রিয় বিবেচনা) নেবো। এটি কমানোর জন্য যা করা প্রয়োজন হবে আমরা সেটি করব।’ তিনি বলেন, সংক্রমণ যেহেতু বেড়ে যাচ্ছে, আমরা বিভিন্নভাবে তা কমানোর চেষ্টা করছি। স্থানীয়ভাবে বিধিনিষেধ দিচ্ছি, দিয়ে এটিকে কন্ট্রোল (নিয়ন্ত্রণ) করার চেষ্টা করছি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে যেটা প্রয়োজন হবে তাই আমরা করব। যেহেতু সংক্রমণটা ঊর্ধ্বমুখী, দৈনিক সংক্রমণ ৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সরকার পরিস্থিতি খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। সে ক্ষেত্রে যেটি উপযুক্ত হবে, সেই সিদ্ধান্তই আমরা নেবো।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আগে আমাদের সংক্রমণ ৭ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখনো অনেক জায়গা আছে যেখানে সংক্রমণ ১০ শতাংশের নিচে। এরই মধ্যে ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে কঠোর বিধিনিষিধে দিয়েছি। তার পরও ঢাকা লোকজন এসে যাচ্ছে। এসব যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। বাস, ট্রেন, যাত্রীবাহী নৌযান বন্ধ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ করেই কিন্তু আমরা এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘সংক্রমণ কমাতে পদক্ষেপ নিতে আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম কাজ করছে। সেই অনুযায়ী যে সিদ্ধান্ত নেয়া উপযুক্ত এবং সঠিক হবে, সেটি আমরা নেবো।’
শাটডাউনের সুপারিশ পরামর্শক কমিটির : করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউনের সুপারিশ করেছে করোনা সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটি। গত বুধবার রাতে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়েছে, করোনা নিয়ন্ত্রণে পূর্ণ লকডাউন (শাটডাউন) প্রয়োজন।
কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা: মোহামাদ শহীদুল্লার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আরো বলা হয়েছে, করোনার ভারতীয় (ডেল্টা) ভ্যারিয়েন্ট কমিউনিটি (সামাজিক) সংক্রমণ হচ্ছে বলে রোগের প্রকোপ বেড়েছে। সভায় বলা হয়েছে, এই ভ্যারিয়েন্টটির সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে সারা দেশেই উচ্চ সংক্রমণ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই পঞ্চাশের বেশি জেলায় অতি উচ্চ সংক্রমণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
পরামর্শক কমিটি বলছে, রোগ প্রতিরোধের জন্য খণ্ড খণ্ডভাবে গৃহীত কর্মসূচির উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অন্যান্য দেশ, বিশেষত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ‘কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া করোনার বিস্তৃতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।’ ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞের সাথেও তারা এ ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। তাদের মতামত অনুযায়ী যেসব স্থান পূর্ণ বন্ধ করে (শাটডাউন) করে দেয়া হয়েছে সেখানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ও জনগণের জীবন রক্ষার জন্য কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সারা দেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ ‘শাটডাউন’ সুপারিশ করেছে।
তারা বলছেন, জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস-আদালতসহ সবকিছু বন্ধ রাখা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে না পারলে আমাদের যত প্রস্তুতিই থাকুক না কেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯’র টিকা সংগ্রহের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নিয়েছেন বলে সভায় তাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন পরামর্শ কমিটির সদস্যরা। এই রোগ থেকে পূর্ণ মুক্তির জন্য ৮০ শতাংশের বেশি মানুষকে টিকা দেয়া প্রয়োজন। বিদেশ থেকে টিকা সংগ্রহ, লাইসেন্সের মাধ্যমে দেশে টিকা উৎপাদন করা ও নিজস্ব টিকা তৈরির জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গবেষণা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টার প্রতি কমিটি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে।
এ দিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৩ হাজার ৮৬৮ জনে।
ময়মনসিংহে ১ জুলাই পর্যন্ত লকডাউন
ময়মনসিংহ অফিস জানায়, করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আজ শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ১১টি এলাকায় চলাচল বন্ধের (লকডাউন) সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা জারি করা হয়। এতে মাসকান্দা (বাসস্ট্যান্ড), চরপাড়া, নয়াপাড়া, কৃষ্টপুর, আলিয়া মাদরাসা, নওমহল, আর কে মিশন রোড, বাউন্ডারি রোড, পাটগুদাম, কাঁচিঝুলি ও গাঙিনারপাড় এলাকায় জনসাধারণের চলাচলসহ সার্বিক কার্যাবলী বন্ধ ঘোষণা করা হলো। তবে এ সময় শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা যেমন- কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষিযন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিরতণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, বিদ্যুৎ, পানি গ্যাস, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি/বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ড্রাগসেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশাকীয় পণ্য ও সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এবং পণ্যবাহী ট্রাক/লড়ি নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত থাকবে।
নোয়াখালীতে লকডাউন বৃদ্ধি
নোয়াখালী অফিস জানায়, নোয়াখালীতে করোনার প্রকোপ না কমায় ছয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় চলমান লকডাউন আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়েছে জেলা প্রশাসন। গতকাল বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সাথে সাথে চৌমুহনী পৌরসভা এবং বেগমগঞ্জের মীর ওয়ারিশপুর ও একলাশপুর ইউনিয়নে লকডাউন ঘোষণা করা হয়।
জেলা প্রশাসক ও করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, প্রথম ধাপে নোয়াখালী পৌরসভা ও সদর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে সাত দিন লকডাউন ঘোষণা করা হয়। তবে করোনার প্রকোপ না কমায় চলমান এ লকডাউন তৃতীয় দফায় আরো সাত দিন বর্ধিত করা হয়েছে। আগামী ২ জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত এ লকডাউন কার্যকর থাকবে। একই সাথে আগের সব বিধিনিষেধ বহাল থাকবে। নোয়াখালীতে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় নতুন করে আরো ১১৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। ৪১৩ জনের নমুনা পরীক্ষায় এ ফল পাওয়া যায়। এতে ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
দোহার নবাবগঞ্জে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত
দোহার (ঢাকা) সংবাদদাতা জানান, ঢাকার চারপাশের সাত জেলায় লকডাউনের পর এবার দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলায় কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, বুধবার ঢাকা জেলা করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কমিটি ভার্চুয়ালি এক জরুরি সভার আয়োজন করে। সভায় জেলা প্রশাসক মো: শহীদুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা-১ আসনের এমপি সালমান এফ রহমান। সভা থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এ দু’টি উপজেলার মানুষজনকে শতভাগ মাস্ক পরিধানের আওতায় আনা, বিভিন্ন জায়গায় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, এ দুই উপজেলা থেকে অন্যান্য উপজেলার সাথে স্থল ও নৌপথ বন্ধ রাখতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে লাল পতাকা টানানো, বিকেল ৫টার পর দোকানপাট বন্ধ থাকবে। পর্যটনকেন্দ্র ও বিনোদন সেন্টার বন্ধ থাকবে। জনসমাবেশ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ ও সীমান্ত এলাকায় চেকপোস্ট বসানো বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়।