নদীর আর্তচিৎকার যখন চিরকুট!

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি সারাদেশ


ঢাকাঃ পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন গান লিখেছেন,

আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে
অকুল দরীয়ায় বুঝি কুল নাইরে…
আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে
অকুল দরীয়ায় বুঝি কুল নাইরে…
আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে
অকুল দরীয়ায় বুঝি কুল নাইরে…

ভাটিয়ালী বাংলাদেশ এবং ভারতের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় গান। বাংলাদেশে বিশেষকরে নদ-নদী পূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর-পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতে ভাটিয়ালী গানের মূল সৃষ্টি, চর্চাস্থল এবং সেখানেই এই লোকসঙ্গীতের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বাউলদের মতে ভাটিয়ালী গান হলো তাদের প্রকৃতিতত্ত্ব ভাগের গান।[১] ভাটিয়ালী গানের মূল বৈশিষ্টা হলো এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে। সাথে থাকে গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ নারীর প্রেমপ্রীতি, ভালবাসা, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদির সম্মিলন। যেমন –

আষাড় মাসে ভাসা পানি
পূবালি বাতাসে,
বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি,
আমার নি কেউ আসে।

কিংবা,

নাই বাইয়া যাও ভাটিয়ালী নাইয়া
ভাটিয়ালী নদী দিয়া
আমার বন্ধুর খবর কইয়ো
আমি যাইতেছি মরিয়া।

আবার নদীকে ঘিরে প্রেমেরও গান আছে, যেমন-

সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা
তোমার বেলায় নেব সখি তোমার কানের সোনা
সখি গো, আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি
তোমার কাছে পয়সা নিব না

ও সুজন সখিরে
প্রেমের ঘাটে পারাপারে দরাদরি নাই
মনের বদল মন দিতে হয়।

কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া/আমার ভাইধন রে কইয়ো/নাইওর নিতো বইলা/তোরা কে যাস কে যাস। ” শচীন দেব বর্মনের এই কালজয়ী গানে বাপের বাড়ি নাইওর যেতে ভাইয়ের আগমনের পথ চেয়ে গ্রামীণ বধূর আবেগতাড়িত আবেদনেও নদীর অস্তিত্ব পাওযায় যায়।

একটি সময় ছিল, নদী মাতৃক বাংলাদেশে নয়নভিরাম নদী-প্রকৃতিকে ঘিরে রচিত হত, গান কবিতা, গল্প, সাহিত্য উপন্যাস ও আরো কত কি। কিন্তু প্রকৃতির প্রধান পুঁজি নদীর আয়তন কমে গিয়ে ও নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে এখন নদী হয়ে গেছে প্রকৃতির অনেকটাই শত্রু। কারণ যে নদীর জলে ছিল মাছ, ভাসত নৌকা সেই নদীর জ্ল এখন বিষাক্ত। যে নদীর পানিতে মানুষ গোসল করতো, কখনো বা পানি পানও করত, সে নদীর পানিতে এখন বিষ। তাই গোসল তো দূরের কথা, ভয়ে মানুষ পশুপাখিকেও নদীতে নিয়ে যায় না। প্রকৃতির এই প্রধান সম্পদ রক্ষা না করলে এমন একটি সময় আসবে যখন আর নদীর অস্থিত্বই থাকবে না, প্রকৃতির ইতিহাসে।

দক্ষিণ এশিয়ায় অন্তর্গত বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৩১০ টি নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশের নদীগুলোকে সংখ্যাবদ্ধ করেছে এবং প্রতিটি নদীর একটি পরিচিতি নম্বর দিয়েছে। এর ফলে তাদের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা এখন ৪০৫ টি। পাউবো কর্তৃক নির্ধারিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী (১০২টি) , উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী (১১৫টি), উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী (৮৭টি), উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী (৬১টি), পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী (১৬টি) এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদী (২৪টি) হিসেবে বিভাজন করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

বাস্তবতা বলছ, অব্যাহত দখল, অবকাঠামো ও দূষণ ধ্বংসের মুখে সারাদেশের নদ-নদী-জলাশয়। নদী থেকে সকল দখলদার-মাছপ্রকল্প-সুইসগেট-বাঁধ-স্বল্প দৈর্ঘ্যের সেতু অপসারণ করতে হবে অবিলম্বে। জাতিসংঘ পানি প্রবাহ আইন ১৯৯৭ ও হাইকোর্টের সকল রায় মেনে, সকল নদীর সীমানা নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, নদী রক্ষা না হলে দেশ রক্ষা হবে না।

প্রধানমন্ত্রী নদী রক্ষায় তার দৃঢ় প্রত্যয় বার বার প্রকাশ করেছেন। নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে, তারা আন্তরিক থেকেও নির্বাহী ক্ষমতার অভাবে খুব বেশি কিছু করতে পারছেন না। আমাদের প্রয়োজন নির্বাহী ক্ষমতা সম্পন্ন একটি শক্তিশালী নদী কমিশন। তবে আমাদের উচ্চ আদালত নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা হিসেবে ঘোষণা করেছেন, অতএব এই সত্ত্বার ভালভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করাও সরকার সহ আমাদের সকলের দায়িত্ব।

বাস্তবতা হচ্ছে আমরা আজ ব্যাপক নদী বিপর্যয়ের শিকার। অধিকাংশ নদীই নাব্যতা হারিয়েছে। ১৯৭১ সালের তুলনায় আমাদের শীতকালের মোট নদীপথ ৮৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ মূলত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর পলি মাটি দিয়ে গঠিত একটি বদ্বীপভূমি। একাদশ শতাব্দিতে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। নদীগুলো ছিল প্রশস্ত, নদীর গভীরতা ছিল, বর্ষাকালে এসব নদী থাকতো প্রমত্তা। এখন সে অবস্থা আর নেই। সারা বছর নাব্যতা থাকে এমন নদীর সংখ্যা এখন সর্ব সাকুল্যে ২৩০টি।

</a
জাতীয় নদী রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর কার্যনির্বাহী সহ-সভাপতি ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, আমাদের দেশে কলকারখানাগুলোই নদী দূষণের প্রধান উৎস। ২০০৮ সনের এক সরকারী গবেষণায় এ তথ্য জানা যায়। এসব থেকে নানারকম দীর্ঘস্থায়ী বিষাক্ত তরল দূষক পরিবেশের সীমাহীন ক্ষতি সাধন করে চলছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত ৯টি দীর্ঘস্থায়ী জৈব দূষক এলড্রিন, ক্লোরডেন, ডিডিটি, ডাইএলড্রিন, এনড্রিন, হেপ্টক্লোর, হেক্সাক্লোর বেনজিন, মিরেক্স ও টক্সাফেন। এগুলো ১৯৯৮ সনে সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ হলেও এর ৭টি বাংলাদেশে এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে বলেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

প্রতি বছর ১৪ মার্চ, আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস বা আন্তর্জাতিক নদী রক্ষায় করণীয় দিবস পািলিত হয়। সারা বিশ্বে বেসরকারি পর্যায়ে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। নদীর প্রতি আমাদের করণীয়? নদী রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব, কতটুকু দায়বদ্ধতা? এটি উপলব্ধি ও স্মরণ করিয়ে দিতেই এমন দিবস পালনের সূচনা। দিবসটি উপলক্ষে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও নানা কর্মসূচি পালন করে। ১৯৯৭ সালের ব্রাজিলে কুরিতিবা শহরে এক সমাবেশ থেকে নদীর প্রতি দায়বদ্ধতা মনে করিয়ে দিতে এ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে এক হয়েছিলেন বিভিন্ন দেশে বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। ব্রাজিল, তাইওয়ান, চিলি, আর্জেন্টিনা, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ওই সম্মেলনে অংশ নেন প্রতিনিধিরা। ওই সম্মেলন থেকেই ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

বেশী বিপদের খবর হল, দেশের ২৯টি প্রধান নদ–নদীর দূষণমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এগুলোর পানির দূষণ বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। মৎস্য অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ দেশের মাছের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৯টি নদী নিয়ে আরেকটি সমীক্ষা করেছে। তাতে দেখা গেছে, মাছের এসব উৎস মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। এসব নদীর পানিতে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মাত্রার ভারী ধাতু পাওয়া যাচ্ছে।

ঝুঁকির মুখে মাছ!!

গত বছরের অক্টোবরে মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ ৯টি নদীর ১১টি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে। রাজধানীর চারপাশের পাঁচটি নদী অর্থাৎ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার পানি এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে যে সেখানকার বেশির ভাগ স্থানে মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। পদ্মার শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জের পাশে ইছামতী নদীতেও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর অ্যামোনিয়ার পরিমাণ মানমাত্রার চেয়ে বেশি। তা ছাড়া এসব নদীতে ক্রোমিয়াম, আয়রন ও জিংকের মতো ভারী ধাতু মানমাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে মানমাত্রা প্রতি লিটারে দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম। অথচ এসব নদীতে পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে দশমিক ৮ থেকে ৮ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘নদী–জলাশয় রক্ষা করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু আমরা দেখছি, আমাদের নদীগুলো দূষণের পর্যায় থেকে এখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর নদী মরে যাওয়া মানে মানুষের খাওয়ার পানি, মাছ ও জলজ প্রাণীর বাসস্থান হারিয়ে যাওয়া। তাই অন্তত নদী রক্ষায় সরকার তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ।’

পরিশেষে বলতে চাই, নদীর বাঁচার আর্তনাদ এখন অনেকটাই মৃত্যুর পূর্বে লেখা চিরকুট।
নদীর বাঁচাও বাাঁচও চিৎকার শুনে আমরা এখন বাঁচি বাঁচি বলেই চিৎকার করছে। নদীকে মেরে নিজে বাাঁচার চেষ্টা করছে আমরা। কিন্তু এই বাঁচা যে আমাদের শেষ রক্ষা হবে না তা বুঝতে চাই না আমরা। তবুও সকলে মিলে আন্দোলন ও সংগ্রাম করে প্রকৃতির প্রধান অলংকার নদীগুলোকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করব। আশারবাণী থেকে শুনতে চাই. ওই দূর আকাশে ভেসে আসছে ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, দেশাত্মবোধাক, পল্লীগীতি ও মুর্শীদি গান। পল্লী কবির সেই গানের শেষ শুনতে চাই এখনো আমরা–

কূল নাই কিনার নাই নাইগো দরিয়ার পারে
আরে সাবধানে চালায়া মাঝি
সাবধানে চালায়া মাঝি আমার ভাঙ্গা তরি রে…
অকুল দরীয়ায় বুঝি কুল নাইরে…

পানসা জলে সাই ভাসায়ে, সাগরেরও বানে
আমি জীবনের ভেলা ভাসাইলাম..
জীবনের ভেলা ভাসাইলাম কেউনা তা জানেরে
অকুল দরীয়ায় বুঝি কুল নাইরে…
আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে
অকুল দরীয়ায় বুঝি কুল নাইরে…

লেখক

রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *