তুহিন সারোয়ার।
গাজীপুরে কিন্ডার গার্টেন স্কুল গুলো টাকা কামানোর কারখানায় পরিণত হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গ্রহন করেছে অভিনব কৌশল। ব্যাঙ্গের ছাতার মত গড়ে উঠা এইসব কিন্ডার গার্টেন স্কুল কর্তৃপক্ষ বছরের শুরুতেই মেতে উঠে অর্থ বাণিজ্যে। শিক্ষাকে ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়ে এসব স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষকদের অর্থ বাণিজ্যে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকরা। জেলা শিক্ষা অধিদপ্তরের তদারকি না থাকায় এসব কিন্ডার গার্টেন স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের মনগড়া মতে চালাচ্ছে শিক্ষাদান কার্যক্রম। অভিভাবকরা হাজার হাজার টাকা ব্যয় করলেও কোমল মতি শিশুরা পাচ্ছেনা সঠিক শিক্ষা। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করছে অভিভাবক মহল। শিক্ষার নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে স্কুল পরিচালকরা মনগড়া নিয়ম নীতি চালু করেছে। সরকারি পাঠ্যতালিকা ছাড়াও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে মাত্রারিক্ত নিজস্ব মনগড়া পাঠ্যতালিকা বইয়ের বুঝা। এ সকল বানিজ্যিক স্কুলের চিত্র অবাক করার মতো। দুধের শিশু থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি বাবদ জন প্রতি নেয়া হয় এক থেকে দুই হাজার টাকা। আবার সেশন ফি’র ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।প্রতিবছর একজন শিক্ষার্থীকে সেশন ফি হিসেবে অতিরিক্ত গুণতে হয় ১ থেকে ২ হাজার টাকা। সে ক্ষেত্রে একটি হিসাবে দেখা যায়, একটি স্কুলে প্রায় ২’শ জন শিক্ষার্থী থাকলে প্রায় ৩ লাখ টাকা কোন রকম খরচ ছাড়াই অতিরিক্ত কামিয়ে নিচ্ছে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কর্তা ব্যক্তিরা। দৈনিক সরেজমিন বার্তার অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেসরকারি এসব বই প্রকাশনী মালিকরা কিন্ডার গার্টেন স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে আর্থিক সখ্যতা গড়ে তুলেছে। তারা স্কুল কর্তৃপক্ষকে মোটা অংকের টাকা দিচ্ছে তাদের প্রকাশনী বই পাঠ্যতালিকা করার জন্য। নতুন বছর শুরু হওয়ার এক মাস আগে থেকেই প্রকাশনী মালিকের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন স্কুলে দৌড়ঝাপ শুরু করে তাদের বই পাঠ্যতালিকা করার জন্য। প্রকাশনী মালিকের কাছ থেকে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা পেয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ এসব বই বাধ্যতামূলক পাঠ্য তালিকা করছে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া অর্থ পুষিয়ে নিতে প্রকাশনী মালিকরা এসব বইয়ের মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রকাশনী ও স্কুল কর্তৃপক্ষের মাঝে অর্থিক লেনদেনের ব্যাবস্থা তৈরি হওয়ায় যে প্রকাশনী যে স্কুলকে হাত করতে পারে সে স্কুল ওই প্রকাশনীর বই পাঠ্যতালিকা করছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের দেওয়া বুক লিস্টেই বই ও লিখকের নাম উল্লেখ করে দেয়। তার পরেও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির শেষ নেই। এসব বই সংগ্রহ করতে পোহাতে হচ্ছে বিরম্বনা।কারণ, সব লাইব্রেরিতে এসব বই পাওয়া যায়না। প্রত্যেক এলাকার যে কোন একটি লাইব্রেরিতে কিনতে হয় এসব বই। এরও একটি কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে,কারণটি হলো, একই এলাকার অন্য কোন লাইব্রেরীতে এ বই দেওয়া যাবেনা প্রকাশনীর সাথে এ শর্তসাপেক্ষে নির্দিষ্ট লাইব্রেরি মালিকরা বই কিনে আনছে। এ বই এলাকার কোন লাইব্রেরিতে না পাওয়ায় নির্দিষ্ট লাইব্রেরি থেকে কিনতে হচ্ছে বইয়ের মূল্য অনুযায়ী। এসব বই শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে কোন উল্লেখযোগ্য নয় বলে অভিভাবকরা জানায়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, কিন্ডার গার্টেন স্কুল, বই প্রকাশনী ও লাইব্রেরি মালিক পক্ষ চক্রের অর্থ বাণিজ্য চাঙ্গা করার জন্য কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা ব্যাবস্থায় চলছে মনগড়া নীতিমালা। এ ছাড়াও রয়েছে বাধ্যতামূলক কোচিং বাণিজ্য। স্কুলের নাম করণে ডায়েরী, ক্যাপ, বেইজসহ বিভিন্ন সামগ্রীর বিক্রী করার বাণিজ্য। শিক্ষার্থীদের কাছে অতিরিক্ত দামে এসব সামগ্রী বিক্রি করেও আর্থিক ফায়দা লুটছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।এসব কিন্ডার গার্টেনে খেলা-ধুলাসহ বিভিন্ন ফি আদায় করা হলেও বেশীরভাগ স্কুলেই বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস, একুশে ফ্রেরুয়ারি পালন করা হয়না। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জয়দেবপুর থানা এলাকায় বেসরকারি এসব কিন্ডার গার্টেন স্কুলের সংখ্যা প্রায় দুই হাজারের উপর। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় এক শ্রেণীর অর্থ লোভী ব্যক্তিরা কেহ নিজস্ব এবং কেহ অন্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে কিন্ডার গার্টেন স্কুল গড়ে তুলেছে। এমন বাড়িতেও স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেখানে শিক্ষার কোন পরিবেশ নেই। নিজের নাম স্বাক্ষর করতে পারেনা এমন ব্যক্তিও কিন্ডার গার্টেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ জানা গেছে। এসব স্কুলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিলেও শিক্ষাদানের ব্যাবস্থা নাজুক। অধিকাংশ শিক্ষকই মাত্র এসএসসি পাস। উন্নত শিক্ষাদানের ব্যানার, সাইনবোর্ড ও পোষ্টার লাগিয়ে ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের মন আকৃস্ট করলেও বাস্তবে শিক্ষার মান খুবই খারাপ বলে জানায় একাধিক অভিভাবক। এসব স্কুলের শ্রেণী কক্ষে ভাল পাঠ দান প্রদান করা হচ্ছেনা। বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে এসব স্কুলে তাদের সন্ত্রানদের লেখা পড়া করাতে হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের দুর্বলতার সুযোগে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো শিক্ষার নামে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। এছাড়া পাঠ্য পুস্তক ও সহায়ক উপকরণ স্কুল থেকে নেওয়া বাধ্যতা মূলক করে শূলে চড়াচ্ছেন অভিভাবকদের। অথচ শিক্ষার্থী প্রতি ধার্য বেতন পরিমান নাম মাত্র সম্মানী দেয়া হচ্ছে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।কোন কোন কিন্ডার গার্টেনে মাত্র ১০০০ টাকা মাসিক বেতন প্রদান করা হয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। এই দৈন্যদশায় যখন চলছে কিন্ডার গার্টেন স্কুলে পাঠদান তখন নামমাত্র বেতন ভোগী শিক্ষক-শিক্ষিকারাও পিছিয়ে নেই গলা কাটার মিছিলে। তারা এক রকম ঘোষনা দিয়েই বাধ্যতামূলক করেছে প্রাইভেট পড়া। স্কুল শুরু এবং ছুটির আগে দুই সেশনে চলে তাদের বাধ্যতামূলক প্রাইভেট বানিজ্য। সেখানে মরার উপরে ফোঁড়া দিতে সিগ্ধ হস্ত শিক্ষকরা।অসামঞ্জস্য টিউশন ফ্রিতে কোন শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়তে অস্বীকৃতি জানালে সে পড়ে শিক্ষকদের দৃষ্টিগ্রাসে। ভাল লেখেও খারাপ ফলাফল, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের চক্ষুশূল হওয়াসহ নানা প্রতিকূলতায় পড়তে হয় ওই শিক্ষার্থীকে। কিন্ডার গার্টেন শিক্ষার এই ইচ্ছাতন্ত্রে অভিভাবকরা ত্যক্ত-বিরক্ত হলেও নিরবে গলা পেতে দিচ্ছেন কিন্ডার গার্টেন শিক্ষার অনিয়মের ছুরিতলে। শিক্ষাকে ব্যবসা হিসেব পরিণত করে এক শ্রেণীর লোকেরা কোমল মতি শিশুদের সর্বনাশ করছে। এসব শিশুরা সঠিক প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছেনা বলে অভিভাবকদের অভিযোগ। শিক্ষার নামে এসব কিন্ডার গার্টেন গুলোর প্রতারনা রোধ অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করছেন সচেতন মহল। তবে শিশুদের মাথায় অতিরিক্ত বইয়ের বুঝা চাপিয়ে দেওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলা শিক্ষা অধিদপ্তর।এসব কিন্ডার গার্টেন স্কুলের শিক্ষানীতি মালার উপর নজর দারি করে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করার দাবি জানিয়েছে সচেতন অভিভাকরা।
মোঃ তুহিন সারোয়ার।